আখে আগ্রহ নেই চাষিদের, কমছে আবাদ
আখ চাষের যোগ্য ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র ২ হাজার ২৪ একর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আখ চাষ শুরু করলেও তার তিন ভাগের এক ভাগও পূরণ করতে পারছেন না মিলের কর্মকর্তারা। দিন দিন আখের আবাদ কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে রয়েছে দেশের বৃহৎ এই চিনিকলটি।
ভারত সীমান্তঘেঁষা জেলা জয়পুরহাটে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড। ১৯৬৩-৬৪ সাল থেকে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। সে সময় দৈনিক আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর দৈনিক আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রার ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়ে ২ হাজার ৩২ মেট্রিক টন হয়। মিলটিতে প্রায় ২০ জাতের আখের আবাদ হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার আওতাধীন এই মিলটি আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর পর প্রায় ৩০ বছর লাভ-লোকসান মিলিয়ে চলে। এরপর ১৯৯৪-৯৫ আখ মাড়াই মৌসুমের পর থেকে মিলটি আর লাভের মুখ দেখেনি। তাছাড়া এক সময় এই মিলটিতে বিভিন্ন স্থান থেকে রেলযোগেও আখ আসতো। বর্তমানে আখের চাষ কমে যাওয়া এবং ট্রাকে করে আখ আসার কারণে রেলপথ বন্ধ রয়েছে।
গত ৯ বছরের আখ মাড়াই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি জমি কমেছে ২০২১-২২ অর্থবছরে। এই মৌসুমে একেবারে আগের অর্থবছরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেডের তথ্য বলছে, ২০১৩-১৪ মাড়াই মৌসুমে মিলটির আওতায় ১১ হাজার ৬০৮ একর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। ২০১৪-১৫ মাড়াই মৌসুমে আখের আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৫৩০ একর জমিতে, ২০১৫-১৬ মাড়াই মৌসুমে ৭ হাজার ৫১২ একর, ২০১৬-১৭ মাড়াই মৌসুমে ৭ হাজার ১৮২ একর, ২০১৭-১৮ মাড়াই মৌসুমে ৬ হাজার ৪৪০ একর, ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে ৬ হাজার ৫০০ একর, ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে ৪ হাজার ৪ একর, ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে ৪ হাজার ৯০২ একর এবং ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে ২ হাজার ২৪ একর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। এই ৯ বছরে ৯ হাজার ৫৮৪ একর জমিতে আখের আবাদ কমেছে।
জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ আখ মাড়াই মৌসুমে চাষি ছিল মাত্র ৩ হাজার ৩৬৫ জন। এর আগে ২০১৩-১৪ মাড়াই মৌসুমে ১৫ হাজার ৯৬ জন চাষি তাদের জমিতে আখের আবাদ করেছেন। এরপর থেকে দিন দিন আখচাষির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ২০১৪-১৫ মাড়াই মৌসুমে ১৩ হাজার ৩০০ জন, ২০১৫-১৬ মাড়াই মৌসুমে ৯ হাজার ৫০১ জন, ২০১৬-১৭ মাড়াই মৌসুমে ৮ হাজার ০১ জন, ২০১৭-১৮ মাড়াই মৌসুমে ৭ হাজার ৬৯০ জন, ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে ৭ হাজার ৬৮১ জন, ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে ৬ হাজার ৪৯০ জন এবং ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে ৬ হাজার ৪৯৫ জন। এই ৯ বছরে ১১ হাজার ৭৩১ জন চাষি আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
যে কারণে আখ চাষে আগ্রহ নেই চাষিদের
আখ বিক্রির জন্য সময়মতো পুঁজি না পাওয়া, পোকার আক্রমণে আখ নষ্ট হলেও কীটনাশক না পাওয়া, আখ চাষে অন্যান্য ফসলের চেয়ে সময় বেশি লাগা, বিক্রির পর সময়ের টাকা অসময়ে পাওয়া, দাম কমের কারণে লাভ কম- এসব কারণ উল্লেখ করে দিন দিন আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা।
এক সময় ২০-৩০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন বিভূতিভূষণ রায়। এখন তিনি আখ চাষ করেন না। মূলত পোকার আক্রমণে আখ নষ্ট হওয়া, সময়মতো পুঁজি না পাওয়া এবং কম লাভবান হওয়ায় আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তিনি।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার জয়দেবপুর গ্রামের এই চাষি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আখ চাষ বাদ দিয়ে এখন বছরে তিন থেকে চারটি ফসল জমিতে চাষ করতে পারছি। এ থেকে আমার মোটামুটি আয় আসছে। গত বছর ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে জমিতে ভুট্টা দিলাম। ভুট্টার সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে মুলা লাগিয়েছিলাম। এতে মোটামুটি লাভবান হয়েছি।
কৃষক হামিদুল ইসলাম বলেন, আখ চাষ করতে গেলে এক বছর থেকে ১৫ মাস সময় লেগে যায়। কাজের মানুষও পাওয়া যাচ্ছে না। আবার আখ চাষে কখনও পোকা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করে সব শেষ করে ফেলে। বছর কয়েক আগে এমন এক ভাইরাসে সব আখ শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমার অনেক টাকার লোকসান হয়।
দোগাছী পূর্বপাড়া গ্রামের কৃষক হামিদুল ইসলাম বলেন, আমি আগে সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে আখ চাষ করতাম। আখ আবাদ করে মিলে গিয়ে ঠিকমতো টাকা-পয়সা পাওয়া যায় না। সরকার কিভাবে টাকা দেয় তা জানি না কিন্তু টাকা আমরা পাই না। আন্দোলন করেও টাকা পাওয়া যায় না। আর আখের আবাদ করা যাবে না। এখন মাত্র সাড়ে ১৬ শতক জমিতে আখ আছে। আখ আবাদ কমিয়ে জমিতে ধান-পাট, বেগুন, করলা, শসাসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছি।
আখ লাভজনক ফসল নয় বলে কৃষক সফিউল আলম বলেন, আমি প্রায় ১২ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করতাম। কিন্তু বর্তমানে দেখছি এটি লোকসানের ফসল, লাভ হচ্ছে না। আখ বিক্রি করছি ৫ টাকা কেজি, সেটাও নয়। এখন সাড়ে ৪ টাকা। আর চিনি কিনতেছি ১০০ টাকা কেজির ওপরে। গত কয়েক মাস আগে এক কেজি চিনি ছিল ৬০-৭০ টাকা। আর এখন ১০০ টাকার ওপরে। অথচ আখের কেজি মাত্র কয়েক পয়সা বাড়ানো হয়েছে। তাহলে আমরা কিভাবে আখ চাষ করব?
জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপক (কৃষি) তারেক ফরহাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আখ একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। আখ চাষ করতে যে সময় লাগে একই সময়ে চাষিরা জমিতে দুই থেকে তিনটি ফসল ফলাতে পারেন। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি ফসলের প্রতি তাদের আগ্রহ রয়েছে। আর ওই ফসল বিক্রিতে সুবিধা রয়েছে। যার কারণে তারা ওই ফসল আবাদ করতে চায়। এছাড়া আখ চাষে পরিচর্যা, কর্তন, পরিবহন করতে শ্রমিক সংকট রয়েছে। এজন্য চাষিরা আখ চাষে অনীহা প্রকাশ করছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সরকার আখের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। এতে চাষিদের নতুন করে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ২০২২-২৩ রোপণ মৌসুমে এই মিলের আওতায় ৬ হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মাঠ পর্যায়ে চাষিদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। তাছাড়া আখ চাষের উপকরণসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
চিনিকলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখলাছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাষিরা এখন আখের সঙ্গে অন্যান্য ফসল লাগাতে পারছে। তারা সাথি ফসল হিসেবে আখের সঙ্গে হলুদ রোপণ করছে। এছাড়া কচু, পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, বেগুন, ধানসহ নানা জাতের ফসল চাষ করা যাচ্ছে। আর এতে কৃষকদের বেশ সাড়া মিলছে। আমরা আশা করছি আগামীতে কৃষকদের আখ চাষে আগ্রহ বাড়াবে।
এসপি