বেড়েছে আমন উৎপাদন, দাম নিয়ে শঙ্কায় কৃষক
সোনারাঙা ধানে ভরে গেছে মাঠ। ভোরের কুয়াশায় উদীয়মান সূর্যের আলোতে ঝিলমিল করছে ধানের শীষ। শুষ্ক বাতাসে হেলে-দুলে আমনের খেত জানান দিচ্ছে মাঠ থেকে গোলায় ফেরার সময় হয়েছে। ধান পরিপক্ব হওয়ায় সারিবদ্ধ হয়ে কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা।
ধান কাটা শেষে বাঁধাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাড়াইয়ের জন্য। যেন পুরো দমে শুরু হয়েছে আমন ধান কাটাই ও মাড়াইয়ের কাজ। এই দৃশ্য রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের প্রতিপাল বগুড়াপাড়া এলাকার। একই দৃশ্য বদরগঞ্জ, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, পীরগঞ্জসহ রংপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ধান কাটা-মাড়াই কাজে কৃষকের পাশাপাশি ব্যস্ততা বেড়েছে দিনমজুরদেরও।
কৃষকরা বলছেন, চলতি মাসেই ধান কাটার কাজ শেষ হবে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে খুশি নন তারা। উৎপাদন খরচ অনুযায়ী ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, অল্প কিছু জমিতে পঁচারি ও কারেন্ট পোকার আক্রমণ ছাড়া ফলন ভালো হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা তাদের।
পীরগাছার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বগুড়াপাড়া এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অগ্রিম ধান পাকায় কিছু ধান পাখি খেয়ে ফেলেছে। পঁচারি ও কারেন্ট পোকার উপদ্রবও ছিল। তবে সব মিলিয়ে এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। অনেকেই ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন। কেউ কেউ ধান মাঠ থেকে গোলায় তুলেছেন। এবার ধানের কাঁচা খড় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
রংপুর নগরের মীরগঞ্জ, বোতলা ও ধর্মদাস পাড়ার বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ফলন ভালো হলেও ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে চিন্তিত তারা। সার ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চাষাবাদে। শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। সরকার যে দাম দিচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচের হিসেব কষলে লোকসানের সম্ভাবনা রয়েছে।
রংপুর নগরীর কাচনা সাহেবগঞ্জ এলাকার কৃষক শামছুল হক বলেন, আগে হামরা যে জমি দোন প্রতি ২০০ টাকা দিয়ে চাষ করছি, এ্যালা সেই জমিত খরচ হওছে ৩০০-৪০০ টাকা। তেলের দাম, সারের দামসহ সোগ কিছুর দাম বাড়ছে। সরকার ধানের দাম দিছে ২৮ টাকা আর চালের দাম ৪২ টাকা। এই দামে হামার মতো কৃষকের লাভ হবার নায়, উল্টা লোকসান হইবে।
মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি সেরুডাঙ্গা এলাকার ধানচাষি আব্দুর রহমান বলেন, নিজে কামলা দিয়াও হামার পোষায় না। একটা জমি চাষ দিবার গেইলে নাগে ১২০০ টাকা। আর এ্যালা ধান কাটাতে নাগোচে সাড়ে তিনশ টাকা। হিসাব করি দেখো হামাক কত খরচ করা নাগে। এবার ফলন ভালো হইছে কিন্তু সরকার যে দাম দিছে তাতে লোকসানের ভয় আছে। এমনটা হইলে তো মাইনসে ধান ছাড়ি অন্য কিছু চাষ করবে।
এদিকে সরকার নির্ধারিত দাম বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন কৃষক নেতারা। তারা বলছেন, আমনের ফলন ভালো হওয়াতে ধান ঘিরে লাভের স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা। এ পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধির সবদিক বিবেচনা করে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও চাষাবাদে উৎসাহ বাড়াতে সরকারকে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণে ভেবে দেখতে হবে।
রংপুর কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষক আসলে কতটুকু লাভের মুখ দেখবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া, তাতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ কারণে উৎপাদক বা কৃষকরা প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম ও বাধা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা বেশি উপকৃত হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ মৌসুমে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এ বছর এক কেজি ধানের সরকার নির্ধারিত মূল্য ৪২ টাকা। যদিও রংপুরে এখনো শুরু হয়নি এই কার্যক্রম।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, এবার কৃষকের জন্য সন্তোষজনক ফলন হয়েছে। ইতোমধ্যে ধান-মাড়াই শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট আবাদের প্রায় ৩০ শতাংশ ধান কেটেছেন কৃষকরা। চলতি মাসেই ধান কাটার কাজ শেষ হবে।
এই আমন মৌসুমে রংপুর মহানগরসহ আট উপজেলায় হাইব্রিড, উফসী ও স্থানীয় মিলে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এর আগের মৌসুমের (২০২০-২১) তুলনায় এবার ২৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়েছে। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি ভালো ফলন হয়েছে। ২০২০-২১ মৌসুমে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর, ২০১৯-২০ মৌসুমে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৫ হেক্টর, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৯৫ হেক্টর এবং ২০১৭-২৮ মৌসুমে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৬১ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছিল।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি