৭৫ হাজারে শুরু, গৃহবধূ রুনার এখন মাসে আয় লাখ টাকা
সংসার সামলানোর পাশাপাশি কেঁচো থেকে সার উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের গৃহবধূ জান্নাতুন ফেরদৌস রুনা। মাত্র ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন কাজ শুরু করলেও এখন মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলার এসএম কুতুবদ্দীনের স্ত্রী জান্নাতুন ফেরদৌস রুনা। তিনি পেশায় একজন গৃহিণী। স্বামী উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা।
জানা গেছে, জৈব সার মাটির জীবন—এমন কথায় নিজের জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহার শুরু করেন। কেঁচো সার ব্যবহারে ভালো ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তিনি কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। ইউটিউব চ্যানেল দেখে বিদেশি কেঁচো ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। পরে ভারত থেকে সংগ্রহ করেন আফ্রিকার ‘নাইট কলার’ ও অস্ট্রেলিয়ান ‘রেড ওয়ান’ জাতের কেঁচো। প্রথম পর্যায়ে ৭৫ হাজার টাকায় ১৫ হাজার কেঁচো সংগ্রহ করেন রুনা। বাড়ির আঙিনায় চৌবাচ্চার মাধ্যমে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করে নিজের জমিতে ব্যবহার করতেন।
প্রতিবেশীরা রুনার সফলতা দেখে কেঁচো কম্পোস্ট সার ক্রয় করেন এবং জমিতে প্রয়োগ করে ভালো ফলন পান। পরে কেঁচো কম্পোস্ট সারের ব্যাপক চাহিদা দেখে এক বিঘা জমিতে তিনটি বেড নির্মাণ করেন। এতে প্রতি মাসে তার আয় বেড়ে যায়। পরে আরও দুই বিঘা জমি নিয়ে বড় পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন। ১৫-২০ জন শ্রমিক প্রতিনিয়ত আমার কারখানায় কাজ করছেন। তারা প্রতি মাসে ৬০-৬৫ টন কেঁচো সার উৎপাদন করছেন। প্রতি কেজি সার বিক্রি হয় ১০ টাকা কেজি দরে। শুধু নিজ জেলা নয়, মোবাইলে বুকিং নিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে জান্নাতুনের কেঁচো কম্পোস্ট সার।
কৃষিতে নারীর এমন অবদানের কারণে ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার লাভ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে কৃষি পুরস্কার পাওয়ায় জেলায় প্রসংশিত ও পরিচিত হন তিনি।
জান্নাতুল ফেরদৌস রুনা বলেন, আমার স্বামী একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তিনি কৃষকদের কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি ও ব্যবহারে পরামর্শ দেন। আমি তার কাছ থেকে প্রথমে উদ্বুদ্ধ হই। পরে ভারত থেকে বিদেশি জাতের আফ্রিকার ‘নাইট কলার’ ও অস্ট্রেলিয়ান ‘রেড ওয়ান’ জাতের কেঁচো সংগ্রহ করি এবং ছোট পরিসরে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে নিজের জমিতে প্রয়োগ করি। এতে রাসয়নিক সারের চেয়ে ফলন বেশি পাই। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় অনেকেই আমার কাছ থেকে কেঁচো কম্পোস্ট সার কিনে তাদের জমিতে ব্যবহার করে ভালো ফলন পাই। এতে আমার পরিচিতি আরও বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমি এখন বড় পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদনে একটি কারখানা করেছি। জেলার বিভিন্ন গরুর খামার থেকে গোবর সংগ্রহ করি। গোবর থেকে তৈরি হয় কেঁচো কম্পোস্ট সার। আমার সার কারখানায় নারী-পুরুষ মিলে ১৫-২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি মাসে তারা ৬০-৬৫ টন সার উৎপাদন করেন। কিন্তু সারের চাহিদা বেশি হওয়ায় এখন আমার উৎপাদিত সার জেলার চাহিদা মেটাতে পারছে না। এছাড়া অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় আমার খামারের সার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আমঝুপি গ্রামের গৃহবধূ আসমা খাতুন বলেন, রুনা আপার পরামর্শে আমি আমার বাড়ির উঠানে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে বিক্রি করি। এই টাকা সংসারে দেওয়ার পাশাপাশি ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছি।
খোকশা গ্রামের বিধবা বুলবুলি খাতুন বলেন, আমি বাড়িতে কয়েকটি গরু পালন করি। আগে গরুর গোবর ফেলে দিতাম। পরে রুনা ভাবির পরামর্শে তার খামার থেকে কেঁচো সংগ্রহ করে বাড়ি ও আশপাশে গর্ত করে কম্পোস্ট সার তৈরি করে বাড়তি টাকা আয় করছি।
স্থানীয় কৃষক ভোলা মিয়া বলেন, দিন দিন রাসায়নিক সারের দাম বৃদ্ধির ফলে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। তাছাড়াও জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেও ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে ভালাে ফলন পাচ্ছি। আমিও রুনা ভাবির পরামর্শ নিয়ে নিজের জমির জন্য কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করব।
কম্পোস্ট খামারে কর্মরত শ্রমিক মহিদুল ইসলাম বলেন, আমি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে গোবর সংগ্রহ করি। ট্রলি ভর্তি করে গোবর সংগ্রহ করে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও বাজারজাত করি। প্রায় সাত বছর আমি এই খামারে কাজ করে সংসার চালাচ্ছি।
শ্রমিক সর্দার সামিদুল বলেন, রুনা আপার খামারে ১০ বছর ধরে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছি। এখানে নারী-পুরুষ অনেক শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পরামর্শ নেওয়ার জন্য খামারে আসেন কৃষকরা। আমরা তাদের পরামর্শ দিয়ে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদনে উৎসাহ যোগাচ্ছি।
জেলা কৃষি অফিস বলছে, জেলায় জৈব সারের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ৫০০ মেট্রিক টন। বিভিন্ন মাধ্যমে উৎপাদন হচ্ছে ২৪৬ মেট্রিক টন। জেলার প্রায় ২৫০০ কৃষক ও ৮১০ জন কৃষাণী পর্যায়ে জৈব সার উৎপাদন হয়ে থাকে। যা চাহিদার অর্ধেক।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার বলেন, মেহেরপুরে জৈবসার বা কেঁচো কম্পোস্ট সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন হচ্ছে অর্ধেক। কৃষকদের আমরা জৈবসার ব্যবহার ও উৎপাদনে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। জেলার একমাত্র নারী উদ্যোক্তা আমঝুপি গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌস রুনার খামারে উৎপাদন হচ্ছে প্রতি মাসে ৬০-৬৫ টন কেঁচো কম্পোস্ট সার। তিনি একজন নারী হিসেবে নিজের সংসার সামলিয়ে মোটা অংকের টাকা আয় করছেন, জেলার কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। আমরা জেলার অন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি যাতে তারা এই কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে কৃষিতে অবদান রাখতে পারে এবং নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
এসপি