রাজবন বিহারে লাখো পুণ্যার্থীর অংশগ্রহণে চীবর দান অনুষ্ঠিত
লাখো পুণ্যার্থীর অংশগ্রহণে রাঙামাটির রাজবন বিহারে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় কঠিন চীবর দানোৎসব। শুক্রবার (৪ নভেম্বর) দুপুরে রাজবন বিহারের ৪৯তম কঠিন চীবর দানোৎসবে বনভান্তের স্মৃতির উদ্দেশ্যে চীবর দান করেন বিহারের উপাসক-উপাসিকা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।
এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শুক্রবার সকালে বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। সকাল ১০টায় শুরু হয় ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত ছিলেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির।
অনুষ্ঠানে রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির বলেন, পৃথিবী থেকে জরা, দুঃখ, গ্লানিবোধ মুছে ফেলার মাধ্যমে মানব হিতার্থে জীবনযাপন করতে হবে। একে অন্যকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। জীবকে ভালোবাসতে হবে। তবেই ভগবান বুদ্ধের দর্শন লাভ সহজ হবে।
কঠিন চীবর দানোৎসবে অংশ নেওয়া উপাসিকা শেফালিকা চাকমা বলেন, চীবর দান অনুষ্ঠানটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে ভান্তেদের উদ্দেশ্যে চীবর উৎসর্গ করা হবে। পাশাপাশি বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় সবাই একযোগে প্রার্থনা করবে।
আরেক ভক্ত মঙ্গল চাকমা বলেন, আমি বরকল থেকে প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে আসি। এটি তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় চীবর দান অনুষ্ঠান। এখানে দেশের বাইরে থেকেও অনেক ভক্ত আসেন চীবর দান করতে। আমরা সবাই মিলে নিজেদের পরিবার-পরিজনসহ সমগ্র দেশবাসীর মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে থাকি।
কঠিন চীবর দানোৎসব উপলক্ষে পুরো বিহার এলাকা লোকে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। রাজবন বিহার মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দোকানিরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন মাঠে। কুমিল্লা থেকে আসা দোকানি আইয়ুব মিয়া বলেন, আমরা প্রতিবছরই এই মেলায় দোকান দিই। এই বছর আমাদের বিক্রি কিছুটা কম।
চীবর বিক্রেতা নয়নতু চাকমা বলেন, আমরা প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার টাকার চীবর বিক্রি করে থাকি। কিন্তু এই বছর বিক্রি একটু কম। আমাদের কাছে থাইল্যান্ডসহ স্থানীয় তাঁতে বোনা চীবর রয়েছে।
রাঙামাটি সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ১ নভেম্বর থেকে ২৫০ জন অফিসারের একটি বিশেষ দল কঠিন চীবর দানোৎসবে নিয়োজিত রয়েছে। চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ রাত পর্যন্ত আমাদের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। জেলা পুলিশের পাশাপাশি জেলা বিশেষ শাখা এবং জেলা গোয়েন্দা শাখার অফিসাররাও নিয়োজিত রয়েছেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুই দিনব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসব।
উল্লেখ্য, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাউপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা এবং সুতা রঙ করে কাপড় বুনে তা সেলাই করে চীবর (ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র) দান করে এই কঠিন চীবরদানের সূচনা করেন। এই পদ্ধতিতে দান করলে কায়িক, বাচনিক মানসিকভাবে অধিক পরিশ্রম হয় এবং অধিকতর পুণ্য লাভ হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা বন বিহারে ১৯৭৪ সালে কঠিন চীবর দানোৎসবের পুনঃপ্রবর্তন করান।
মিশু মল্লিক/এমজেইউ