কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে তেঁতুলিয়ায় ছুটছেন পর্যটকরা
উত্তরের মেঘমুক্ত আকাশে হাসছে শ্বেতশুভ্রের কাঞ্চনজঙ্ঘা। মেঘের আড়াল থেকেই উঁকি দিয়ে ডাকছে পর্যটকদের। চলতি মাসে তিন-চার দিন অল্প সময়ের জন্য দেখা গেলেও সোমবার (১৭ অক্টোবর) ভোর থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রূপ। কাঞ্চনজঙ্ঘার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ছুটছেন পর্যটকরা। পর্যটকদের সমাগমে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে সীমান্তবর্তী এই উপজেলা।
ভোরে তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণারে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী পর্যটকরা বিমুগ্ধ চিত্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধুবান্ধব নিয়ে। এসেই সীমান্ত প্রবাহিত মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত ডাকবাংলোয় দাঁড়িয়ে স্মার্টফোনে ধারণ করছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য। সেলফি তুলছেন, ছবি ও ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসা ফিরোজ-মিথিলা দম্পতি বলেন, আমরা রংপুর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে তেঁতুলিয়ায় ছুটে এসেছি। আমরা অনলাইনে দেখেছি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে মেঘমুক্ত আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত দেখা যায়। গত সাত দিন কুয়াশা থাকার কারণে দেখা যায়নি। আমরা আজ সকালে এসেই দেখতে পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি। আর এখানকার পরিবেশ এতো সুন্দর তা এখানে না এলে হয়তো বুঝতে পারতাম না। এখানে নদী, ভারত, নেপাল তিনটি দেশ দেখতে পেরে সুভাগ্যবান মনে করছি। বিশেষ করে এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে কোনো পাসপোর্ট লাগছে না। মনে হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার আরও কাছে যাই, এতটাই লোভ লাগছে।
রাজশাহী থেকে ঘুরতে আসা ফাতেমাতুজ্জোহরা সিনথি বলেন, কাছ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে অনেক দিন ধরেই অপেক্ষা করছি। তাই আমরা রাজশাহী থেকে পরিবার নিয়ে ছুটে এসেছি। যদিও অসুস্থ্য, তারপরও বাচ্চাদের নিয়ে এসেছি। আমরা জেনেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা সকালে এক রূপ ধারণ করে, দুপুরে আরেক রূপ ধারণ করে। আসলে পঞ্চগড় অনেক সুন্দর। পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাচ্ছি, অনেক ভালো লাগছে।
একই কথা বলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে নেপালেই আছি। পাহাড় ও নদীর সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে।
ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা নুশরাত জাহান বলেন, কিছু দিন ধরেই আসতে চাচ্ছি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। কিন্তু গত কয়েক দিন দেখা যায়নি বলে জানতে পারি। আজ সকালে খালি চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়েছি। দেশের মাটি থেকে যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পারছি, এটা খুব ভালো লাগছে।
রংপুর থেকে আসা ইব্রাহিম রাজ বলেন, আমরা দুই বন্ধু রংপুর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছি। গতকাল দেখতে পারিনি। আজ ভোরে দেখতে পেরে তার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি ফ্যামেলি মেম্বার নিয়ে আসতাম। আবার আসবেন বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সময়টায় খুব কাছ থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। এ বছরে কদিন সামান্য দেখা গেলে মেঘ ও কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছিল না। ঈদ-ই মিলাদুন্নবী ও পূজোর ছুটিতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল, কিন্তু দেখা না যাওয়ায় অনেকে হতাশা নিয়েই ফিরে গেছেন অনেক পর্যটক।
এ অঞ্চল থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে তুষার আচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র হিমালয় পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার, ভুটানের দূরত্ব ৬৪ কিলোমিটার, চীনের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার, শিলিগুড়ির দূরত্ব ৮ কিলোমিটার আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র (আকাশ পথে) ১১ কিলোমিটার। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে তাকালে মনে হবে চোখের সামনেই সাদা পাহাড়। ভোরের আকাশে বরফ আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম পর্বতটি বেশ উপভোগ্য। কখনো তা রুপালি চকচকে রূপ ধারণ করে।
এছাড়াও এখান থেকে সন্ধ্যায় দেখা মেলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাঝে যে কালচে পাহাড়টা দেখা যায় সেটি পাহাড়ের ঢালে ভারতের প্রসিদ্ধ শহর দার্জিলিং। সন্ধ্যায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ডাকবাংলোর নদী মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়ে উত্তরের পাহাড়ের দিকে তাকালে যেসব আলো দেখা যায়, সেটি শিলিগুড়ি শহরের।
ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই পর্যটকের সমাগম ঘটে থাকে এখানে। বিশেষ করে এ সময়টাতে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে প্রচুর পর্যটক এসে থাকে। এবারও পর্যটকরা আসছেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও তারা এখানকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদাই ট্যুরিস্ট ও থানা পুলিশসহ প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, প্রতি বছর হেমন্ত ও শীত ঋতুতে কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় রূপ উপভোগ করতে ভ্রমণপিপাসুরা আসছেন। আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের তীর্থস্থান তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোয় বিভিন্ন দর্শনীয় স্থাপনা নির্মাণ করেছি। পর্যটকদের বসার জন্য গ্যালারি করা হয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা সহজে দেখার জন্য ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন রেস্ট হাউস আমরা প্রস্তুত রেখেছি।
এসকে দোয়েল/আরএআর