স্কুলে কেউ হাফসার সঙ্গে কথা বলে না, পাশেও বসে না
বাবা ফিরোজ মোল্লা ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। আর মা রেবা বেগম অন্যের বাসায় কাজ করেন। দুজনের রোজগারে কোনো মতে চলে তাদের সংসার। তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সাড়ে ৮ বছরের হাফসা।
তার শরীরে অজানা রোগ বাসা বাধায় মা গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, সারাক্ষণ মেয়ের সঙ্গে থাকতে হয় তাকে। বছরখানেক আগেও স্কুলে যেত হাফসা। সে স্থানীয় ১৬৫ নং হাজেরা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। কিন্তু শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বিকৃতি দেখা দেওয়ায় অন্য শিক্ষার্থীরা সংক্রমিত হতে হবে পারে এই ভয়ে হাফসাকে স্কুল যেতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে বাসায় কান্নাকাটি করে হাফসা। কখনও কখনও মাকে না জানিয়েই স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার রোগের কারণে আতঙ্কিত এলাকাবাসী হাফসাকে বকাবকি করে বাড়িতে পাঠিয়েতো দেয়। এরপর থেকেই ঘরবন্দি শিশুটি। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম কাউনিয়া সৌদি সংস্থা মসজিদ সংলগ্ন একটি বাসায় থাকেন হাফসারা।
জন্মের পর দুই বছর সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। এরপর থেকেই ক্রমে ত্বকে ফোসকার মতো পড়তে শুরু করে তার। যা দিনে দিনে আরও বাড়তে থাকে। এখন হাফসার বয়স সাড়ে ৮ বছর। তার মুখমণ্ডল, দুই হাত, পশ্চাৎদেশসহ বিভিন্ন স্থান বিভৎসভাবে বিকৃত হয়ে গেছে। ক্ষতস্থানে সারাক্ষণ চুলকায় এবং ব্যথায় চিৎকার করে।
হাফসার বাবা ফিরোজ মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় বছর আগে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছিলাম হাফসাকে। ভর্তি করানোর পরে ডাক্তার একটি টেস্ট করাতে বলেন। টেস্টটির দাম ছিল ১৬ হাজার টাকা। ওই পরিমাণ টাকা না থাকায় পরীক্ষা না করিয়েই হাফসাকে নিয়ে বরিশাল চলে আসি। এখন মাঝে মাঝে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখানেতো এর চিকিৎসা নেই। তারপরও মনের সান্ত্বনার জন্য যাই।
তিনি বলেন, আমার মেয়ের কি রোগ হয়েছে সেটিই জানতে পারিনি। আমার যদি অনেক টাকা থাকতো তাহলে হয়তো মেয়েটার চিকিৎসা করাতে পারতাম। কিন্তু অটো চালিয়ে কি এতো বড় রোগের চিকিৎসা চালানো সম্ভব?
শিশু হাফসা কান্না করতে করতে বলে, আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে, আমার ব্যথা সবার গায়ে হবে দেখে। আমার খুব খারাপ লাগে স্কুলে যেতে পারি না বলে। কেউ আমার পাশে আসে না। সবাই আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়।
হাফসার মা রেবা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাফসা যে রোগে আক্রান্ত তা ছোয়াচে না। কারণ, সাড়ে ৬ বছর ধরে সে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আছে। ঘরের অন্য কেউ আমরা আক্রান্ত হইনি। আফসোস হলো আমার মেয়েকে নিয়ে দিনে আমি বাইরে বের হতে পারি না। মানুষ তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, এক বছর আগেও ক্ষতস্থান ঢেকে স্কুলে যেত। কিন্তু সে যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠে তখন স্কুল থেকে না করে দিয়েছে। এরপর থেকে আর স্কুলে যেতে পারেনি। তবে হাফসা স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্না করে। সর্বশেষ স্থানীয় ডা. খলিলুর রহমানকে দিখিয়েছিলাম ২৬ সেপ্টেম্বর। তিনি হাফসাকে দেখে ওষুধ দিয়েছেন। ভিজিটও রাখেননি। ওষুধ কিনে দিয়েছেন। তবে তিনিও বলতে পারেননি হাফসা কি রোগে আক্রান্ত?
হাফসার চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছেন সরকারি ব্রজমোহন কলেজের ইংরেজী বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাফিন মাহমুদ।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের দিকে হাফসার মা আমাদের মেসে রান্না করতো। তখন হাফসা এই রোগে আক্রান্ত ছিল। তখন হাফসার শরীরে ক্ষত কম ছিল। তখন থেকেই মেসের শিক্ষার্থীরা টাকা সংগ্রহ করে ওর ওষুধের জন্য সহায়তা করতাম। এখনো সহায়তা করে যাচ্ছি। কিন্তু সেই টাকায় হাফসার চিকিৎসা সম্ভব না। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে অসহায় এই পরিবারের শিশু মেয়েটির চিকিৎসা হতো।
একই এলাকার বাসিন্দা বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়েটির জন্য আমার খুব মায়া হয়। তার চিকিৎসার সহায়তার জন্য আমি চেষ্টা করছি। পরিবারটি সত্যিকার অর্থেই অসহায়। যখন যতটুকু পারি সহায়তা করেছি। কিন্তু তাতে সুচিকিৎসা হয়নি। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানান এই জনপ্রতিনিধি।
এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমির হোসেন বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ওয়ার্ডে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত কোনো শিশুর বিষয়ে আমার জানা নেই। তাদের পরিবার থেকে আমাকে কেউ জানায়নি। জানালে তার চিকিৎসার সহায়তা করবো।
হাজেরা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিসেস কনা বলেন, শিশুটি অসুস্থ থাকায় ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তার কাছে যেতে ভয় পায়, পাশে বসতে ভয় পায়। এজন্য আমরাই হাফসাকে স্কুলে আসতে নিরুৎসাহিত করেছি। তবে শিশুটি স্কুল থেকে বই নেয় এবং বাসায় লেখাপড়া করে। পরীক্ষা এলে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনার (প্রতিবেদক) মাধ্যমে শিশুটি আক্রান্তের খবর জানলাম। ওই শিশুর চিকিৎসার জন্য আমি সর্বাত্মক সহায়তা করবো। আশা করি সুচিকিৎসা পেলে শিশুটি সুস্থ হবে এবং পুনরায় স্কুলে যেতে পারবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এমএএস