মিশ্র ফলের চাষ করে সাখাওয়াত এখন কোটিপতি
আমগাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে চার ফুট উচ্চতার একেকটি গাছ। ডালে থোকায় থোকায় ধরে আছে বরই। পরিপক্ব বরইগুলো দেখতে অনেকটা লাল ও সবুজাভ আপেলের মতো। ৯৬ বিঘার বিশাল এই বাগানে এবারই প্রথম বরই ধরেছে নওগাঁর সাপাহার উপজেলার শিরন্টি ইউনিয়নের ফুটকইল গ্রামের কৃষক সাখাওয়াত হাবিবের মিশ্র ফলের বাগানে। মিশ্র ফলের চাষ করে তিনি এখন কোটিপতি। পাশাপাশি তার বরই বাগানে কাজ করে খেয়েপরে সুখে আছে আরও ১০০টি পরিবার।
এক সপ্তাহ ধরে বরই বিক্রি শুরু করেছেন কৃষক সাখাওয়াত। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ মণ বরই নামছে তার বাগান থেকে। এবার বরই বিক্রি প্রায় এক কোটি টাকা পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।
গত বছর আমের মৌসুমে মিশ্র ফলের এই বাগান থেকে ২৫ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছিলেন সাখাওয়াত। মিশ্র ফল বাগান করে তিনি এলাকার অন্য কৃষকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এই বাগান দেখে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন তার বাগান দেখতে বহু লোক আসেন এবং তার কাছ থেকে মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলার পরামর্শ নেন।
বিশাল এই মিশ্র ফল বাগানটি অবস্থিত নওগাঁর সাপাহার উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে শিরন্টি ইউনিয়নের ফুটকইল গ্রামে। ৯৬ বিঘা জমিজুড়ে দুই বছর আগে গড়ে তোলা এই বাগানে আম্রপালি, আশ্বিনা, বারিফোর ও গৌড়মতি জাতের আমগাছ রয়েছে। তবে আম্রপালি জাতের আমগাছই বেশি। আমগাছের সারির ফাঁকা জায়গায় লাগিয়েছেন বল সুন্দরী, কাশ্মীরি আপেল, বেবি কুল, সেডলেস ও থাইকুল জাতের বরইগাছ। ১১ হাজার ৭০০টি বরইগাছের মধ্যে বল সুন্দরী জাতের বরইগাছই বেশি।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ছয় ফুট উচ্চতার আমগাছের সারির মাঝে চার থেকে সাড়ে চার ফুট উচ্চতার একেকটি বরইগাছ। এসব গাছের ডালে থোকায় থোকায় ধরে আছে বরই। আমের গাছগুলোয় মুকুল এসেছে। বিশাল সেই বাগানে ১০ থেকে ১২ জন করে শ্রমিক বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গাছ থেকে পাকা বরই ছিঁড়ছেন। বাগান থেকে সদ্য তোলা বরই কিনতে রাজশাহী ও পাবনা থেকে এসেছেন বেশ কয়েকজন।
সাখাওয়াত হাবিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরে প্রতি বিঘা জমি ৩০ হাজার টাকা চুক্তিতে ২০১৮ সালে ফুটকইল গ্রামের ওই মাঠে ৯৬ বিঘা জমি ১২ বছরের জন্য ইজারা নেন তিনি। ওই বছরেই ইজারা নেওয়া জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ১২ হাজার ৮০০টি আমের গাছ লাগান। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে সেই বাগান পরিদর্শনে এসে সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমগাছের সারির ফাঁকা জায়গাগুলোয় বরইগাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। তার পরামর্শমতো তিনি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বরইগাছের চারা সংগ্রহ করেন এবং আমগাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে এক ফুট লম্বা সমপরিমাণ ১১ হাজার ৭০০টি বরইগাছের চারা রোপণ করেন।
গত বছরের মে মাসে তিনি এসব চারা রোপণ করেন ৯৬ বিঘা জমিতে বরই চাষ করতে তার প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ টাকার বরই বিক্রি করেছেন তিনি। আরও অন্তত ৯০ লাখ টাকা পাবেন বলে আশা করছেন।
সাখাওয়াত বলেন, ২০০৭ সালে তার নিজের একটি মোটরসাইকেল ও মায়ের দেওয়া একটি গাভি বিক্রি করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় পত্নীতলায় নির্মইল এলাকায় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১২ বিঘার একটি আমের বাগান তিন বছরের জন্য ইজারা নেন। ওই বাগান পরিচর্যা করে পরের বছরই সেই বাগানের আম বিক্রি করে তিনি চার লাখ টাকা আয় করেন। লাভের সেই টাকা দিয়ে ১২ হাজার টাকা বিঘা চুক্তিতে ১২ বছরের জন্য নির্মইল এলাকায় ২০ বিঘা জমি ইজারা নেন। সেখানে গড়ে তোলেন আমের বাগান। এরপর প্রতিবছর তার পুঁজি বাড়তে থাকে। সাপাহার ফুটকইল এলাকার ৯৬ বিঘার ওই মিশ্র ফল বাগান ছাড়াও সাপাহার ও পত্নীতলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে তার ৩৫০ বিঘার আম বাগান রয়েছে।
বেশি সুস্বাদু হওয়ায় বরই চাষ হচ্ছে সবেচেয়ে বেশি। আম লাভজনক হলেও চারা লাগানোর প্রায় দুই বছর পর ফল ধরে। কিন্তু মিশ্র ফল বরই অল্প সময়ে পাওয়া যায়। অধিক লাভের আশায় বরই চাষে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ি। এ বছর প্রতি মণ বরই পাইকারি দুই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাব অনুযায়ী এক কোটি টাকার ফল বিক্রি হবে, যদি বাজার ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, বলেন সাখাওয়াত।
সাখাওয়াত হাবিবের সাফল্যে ইতোমধ্যেই এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এতে এলাকার অনেক যুবক বরই চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তারা জানান, অন্যান্য ফসলের তুলনায় মিশ্র চাষ অধিক লাভজনক। মিশ্র বাগানে তেমন কোনো পরিচর্যা করতে হয় না। প্রথমে গাছ লাগানো এবং জমি তৈরির পর কীটনাশক ও যৎসামান্য পরিচর্যা ছাড়া কঠিন কোনো পরিচর্যা করতে হয় না।
শিক্ষক আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বদলগাছি উপজেলা থেকে বাগানটি দেখতে এসেছি। অনেকের মুখ থেকে শুনেছি সাখাওয়াত হাবিবের বাগানের কথা। এখানে এসে অনুপ্রেরণা পেলাম এবং অন্যকে তার সফলতার গল্প বলব বাগানটি সম্পর্কে। বাগানটি সবাইকে একবার এসে দেখে যাওয়া উচিত। কারণ, অনুপ্রেরণা পাওয়ার জন্য। আমি নিজেও একটি বাগান করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেখার পর। খুব সুন্দর পরিবেশ এখান থেকে প্রত্যেকের শিক্ষা নেওয়া উচিত। একজন বেকার যুবক কৃষিকাজ করে কোটিপতি হতে পারেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সবচেয়ে বড় কথা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এত সুন্দর একটি বাগান চমৎকার দৃশ্য, যা কল্পনাও করা যায় না।
কৃষিশ্রমিক সাইজ উদ্দিন বলেন, এখানে জমির বেড তৈরি, পানি সেচ, আম ভাঙ্গা, বরই ভাঙ্গাসহ সব ধরনের কাজ বছরজুড়ে থাকে। প্রতিদিন ৪০০ টাকা আয় আসে বাগান থেকে।
ফল বিক্রেতা হারুন-অর রশীদ বলেন, আমি মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হাবিব ভাইয়ের বাগান থেকে বরই ও আমসহ নানা ধরনের ফল কিনি। এত বড় বাগান সাপাহার, পোরশার মধ্যে এটিই। এখান থেকে ফল কিনে বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি করি। বরই মৌসুমে প্রতিদিন ১৫০-২০০ ক্যারেট কিনি। এই সিজিনে বরই প্রতিমণ ২০০০ থেকে ২৪০০ টাকায় কিনছি। তিনি অন্য কারও কাছে ফল বিক্রি করেন না, তাই লাভের অংশটা বেশি থাকে।
সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মজিবর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাখাওয়াত হাবিব যেন আরও বেশি লাভবান হতে পারেন, এ জন্য তার আম বাগানের ফাঁকা জায়গা ফেলে না রেখে সেখানে বরই চাষ করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন তিনি তার উপকার পাচ্ছেন এবং তার দেখাদেখি অন্য কৃষকেরাও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। বহু কৃষক এখন আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন। আমের পাশাপাশি প্রতিবছরই উপজেলায় বরই চাষ বাড়ছে। বর্তমানে উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিজুড়ে বরই চাষ হচ্ছে।
এনএ