দেশীয় প্রযুক্তিতে প্রাণ পেল ডেমু ট্রেন, খুশি যাত্রীরা
বছরের পর বছর নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার পর দেশীয় প্রযুক্তিতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে ডেমু ট্রেন। চীন থেকে কেনা এই ট্রেন মেয়াদের অর্ধেক সময় আগেই অকেজো হয়ে পড়ে। মেরামতের জন্য চীনের সেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করে প্রায় বিক্রয়মূল্যের কাছাকাছি খরচ। পরে ট্রেনগুলো সচল করতে এগিয়ে আসেন দেশের প্রকৌশলীরা। তারা চীনের প্রযুক্তি সরিয়ে নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিজেল ওয়ার্কশপে সচল করেন একটি ডেমু ট্রেন। বাকি ১৯টি ট্রেন মেরামত করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অকেজো ডেমু ট্রেন সচল হওয়ায় খুশি যাত্রীরা।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ওই ট্রেনের মাধ্যমে কাছাকাছি দূরত্বে ব্যাপক যাত্রী পরিবহন করা। চীনের তানসন ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ওই ডেমু ট্রেনের নির্মাতা। ট্রেনগুলো বিশ্বমানের ও আধুনিক। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ওই ট্রেনগুলো এক ধরনের বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে পরিচালিত।
যে প্রযুক্তি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে হস্তান্তর করেনি। এর মডিউল বিকল হলে নতুন মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর জন্য ধরনা দিতে হয় চীনা প্রকৌশলীদের কাছে। যা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। একটি ডেমুতে ৪০টি মডিউল রয়েছে। যার একটির দাম প্রায় ৭ লাখ টাকা। চীনা প্রকৌশলীরা প্রযুক্তি হস্তান্তর না করায় একটার পর একটা ট্রেন বিকল হতে থাকে।
জানা গেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানের সহযোগিতা চাওয়া হয়। আসাদুজ্জামান ডেমু নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণাগার হিসাবে তিনি বেছে নেন সৈয়দপুর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের একটি কক্ষ। ৭২ দিনের প্রচেষ্টায় তিনি উদ্ভাবন করে ফেলেন বাস ট্রাকের মতোই ডেমু চালানোর প্রযুক্তি। ব্যয়বহুল মডিউল সরিয়ে দেন তিনি। সেক্ষেত্রে বসানো হয় মাত্র দুটি কন্ট্রোলার। এতে চালু হয়ে যায় অচল এক সেট ডেমু ট্রেন।
রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন থেকে ট্রায়াল রানে কিছু সংখ্যক যাত্রী নিয়ে পঞ্চগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সদ্য সচল হওয়া ডেমু ট্রেনটি।
এ সময় কথা হয় ট্রেনটির কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে। ট্রেনের যাত্রী মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ট্রেনগুলো চালু হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত যাতায়াত করেছি। বন্ধ হওয়ায় কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েছিলাম। এখন শুনছি আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে ট্রেনটি চালু করা হয়েছে। ভালোই লাগছে। আমি আবার আগের মতো এই ট্রেনে যাতায়াত করতে পারব।
সুস্মিতা রানী নামে আরেক যাত্রী বলেন, এই ট্রেনগুলো অনেক দ্রুত চলে, আরামদায়ক, ভালোই লাগত যাতায়াত করতে। হঠাৎ জানতে পারলাম এই ট্রেনের প্রযুক্তি নষ্ট হওয়ায় এগুলো অচল হয়ে গেছে। আমরা এক ধরনের ভোগান্তিতে পড়ি। তবে আবার ট্রেনগুলো চালু হচ্ছে শুনে ভালো লাগছে। আবার আগের মতো এই ট্রেনে আমরা যাতায়াত করতে পারব।
যাত্রী রায়হান রাফি বলেন, ট্রেনগুলো দেশি প্রকৌশলীরা সচল করতে পেরেছে শুনে ভালো লাগল। এভাবে আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা সবক্ষেত্রেই অবদান রাখুক এটাই চাওয়া। ধন্যবাদ তাদেরকে।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) মো. সাদেকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ওই ট্রেনগুলো। স্বল্প দূরত্বের হলেও দীর্ঘ দূরত্বেও চালানো হয়েছে ট্রেনগুলো। ২০২০ সালে মেরামতের অভাবে ট্রেনগুলো বিকল হয়ে যায়। পরে আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা এই ডেমু ট্রেন মেরামতে দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উদ্যোগী হন।
পার্বতীপুরে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার (কেলোকা) প্রধান নির্বাহী (সিএক্স) মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে ডেমু মেরামত আমাদের বিশাল এক অর্জন। একে বড় সাফল্য বলা যেতে পারে। এ প্রযুক্তিতে ট্রেন মেরামত করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অকেজো ডেমু মেরামত করে আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা যুগান্তকারী সাফল্য দেখিয়েছেন। এ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করতে গিয়ে আমাদের জনবল দক্ষ হয়েছেন। তাদের মাধ্যমে পরবর্তী মেরামত কাজ সহজ হবে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা এক সেট ডেমু সচল করতে সক্ষম হয়েছি। দুই মুখে দুটি ইঞ্জিন মাঝখানে একটি কোচ। এসব আধুনিক ট্রেনে পর্যায়ক্রমে লোড বাড়িয়ে ট্রায়াল রান (পরীক্ষামূলক চলাচল) সম্পন্ন করছি আমরা। তিন মাস ট্রায়াল রান চলবে, সব কিছু ঠিক থাকলে বাকি ১৯ সেট ডেমু সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট- ডেমু ট্রেনে দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন ও মাঝখানে বগি থাকে। একেকবার ১৪৯ জন যাত্রী আসনে বসতে পারেন, সেইসঙ্গে দেড়শ যাত্রী দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারেন। ডেমু ট্রেন মূলত কম দূরত্বে যাত্রী পরিবহনের জন্য। যাত্রীদের সেবা আরও উন্নত, সহজ এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যুক্ত হয় ২০টি ডেমু ট্রেন।
চীনের তানসান রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেড থেকে এই ডেমু আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৬৪৫ কোটি টাকা। ট্রেনগুলোর মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০ বছর। সে হিসেবে ২০১৩ সালে তৈরি করা এসব ডেমু ট্রেনের চলার কথা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।
আরএআর