ধার করা সন্তান দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে শিক্ষিকা
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে ধার করা সন্তান দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি আদায়ের অভিযোগ উঠেছে প্রাথমিকের এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। এ ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অভিভাবকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাগেশ্বরী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা আলেয়া সালমা চলতি বছরের ১৪ মার্চ থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করছেন। গর্ভধারণ না করেও এ ছুটি নিতে তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেন। প্রতিবেশীর সন্তানকে নিজের সন্তান বলে ছুটি নেন তিনি।
এদিকে কয়েক মাস না যেতেই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। অভিযোগ রয়েছে, ছুটি নেওয়ার পুরো বিষয়টি প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা, উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আবু নোমান মো. নওশাদ আলীর যোগসাজশে হয়েছে।
জানা যায়, আলেয়া সালমা বদলি সূত্রে ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুনিয়ারহাট বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০১৯ সালে বিয়ে করেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কাগইল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শফি আহমেদ স্বপনকে। বিয়ের পর থেকে বগুড়ায় চলে যান আলেয়া সালমা। এরপর করোনার কারণে দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল স্কুল-কলেজ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও তিনি স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। এ সময় তিনি চিকিৎসাসহ নানা অজুহাতে ছুটি নিয়েছেন।
সর্বশেষ মা না হয়েও মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন আলেয়া সালমা। চলতি বছরের ১৪ মার্চ সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিন দেখিয়ে ১৩ মার্চ থেকে ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু গর্ভকালীন সালমার শারীরিক কোনো পরিবর্তন বিদ্যালয়ের সহকর্মীদের নজরে পড়েনি। এ কারণে তিনি ১৩ মার্চ কোলে শিশুসন্তান নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে হাজির হন। জমা দেন ছুটির আবেদন।
মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তান পড়েন এমন কয়েকজন অভিভাবক জানান, মাঝে-মধ্যে আলেয়া আপা স্কুলে আসতেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হতো। তাকে দেখে সন্তান-সম্ভাবা মনে হয়নি।
অভিভাবক ফরিদুল ইসলাম, আব্দুল মমিন, ফরিদা বেগম জানান, আলেয়া আপা ভুয়া সন্তান দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন। আর এসব করে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক ও অফিসাররা।
বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরা জানান, নাগেশ্বরী থাকা অবস্থায় তিনি আসতেন। তবে বগুড়া যাওয়ার পর তাকে আসতে দেখতাম না। সন্তান হওয়ার বিষয়টি তারা শুধু শুনেছেন, দেখেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আলেয়া সালমার ঘরে প্রথম স্বামীর ২ সন্তান, দ্বিতীয় স্বামীর ১ সন্তান রয়েছে। তৃতীয় (বর্তমান) স্বামীর ঘরে কোনো সন্তান না থাকলেও তিনি নিজেকে চার সন্তানের জননী হিসেবে দাবি করেন। তবে শিক্ষা অফিসে শুধুমাত্র প্রথম স্বামীর দুই সন্তানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা আছে।
এ বিষয়ে ওই শিশুর মা শারমিন জানান, ‘সালমা আমার আত্মীয়ের মতো। আমি সন্তানসহ তার সঙ্গে কুড়িগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার বাচ্চা তার হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে সেটা আমি কীভাবে বুঝব।
তিনি আরও বলেন, তার বড় মেয়ের নাম আফিফা। বয়স পাঁচ বছর। আর ছোট মেয়ের নাম আশফিয়া। মার্চ মাসে আশফিয়ার জন্ম হয়েছে।
শিক্ষিকা আলেয়া সালমা বলেন, কী হয়েছে না হয়েছে, সবাই জানেন। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এটিও সবাইকে ম্যানেজ করে আমি ছুটিতে আছি। শিক্ষা অফিসের বড়বাবু এসব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আপনারা নিউজ করে আমার কিছুই করতে পারবেন না। যতদিন আমার ট্রান্সফার হবে না, ততদিন আমি ছুটি নিয়েই চলব। আমাদের সিস্টেম আছে। চাকুরিচ্যুত করার ক্ষমতা সরকারেরও নেই।
প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শিক্ষক আলেয়া সালমা নিয়মমাফিক ছুটিতে আছেন।
উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান বলেন, আলেয়া সালমা তার প্রতিবেশী বোন হয়।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার আবু নোমান মো. নওশাদ আলী বলেন, বিধি অনুযায়ী শিক্ষিকার মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ যদি অন্যের বাচ্চাকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়, তাহলে কিছু করার নেই। কেননা আমরা তো আর ডিএনএ পরীক্ষা করি না, করার উপায়ও নেই।
নাগেশ্বরী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মোবাশ্বের আলী বলেন, আলেয়া সালমার সন্তানের বিষয়টি যদি মিথ্যা হয়ে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা জাহান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এখনই খোঁজ-খবর নিচ্ছি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমি কয়েকদিন আগে শুনেছি। শিক্ষকদের প্রতিবেদন দিতে বলেছি। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জুয়েল রানা/এসপি