যেভাবে ‘গরিবের ভরসা’ হয়ে উঠেছিলেন রহিম উদ্দিন ও করিম উদ্দিন
উত্তরের প্রাচীনতম জেলা রংপুর। তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া বিধৌত এ জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ গরিব ও নিম্ন আয়ের। যাদের বেশির ভাগই অভাবী ও খেটে খাওয়া। গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষদের পরিচিত এ শহরের একটি সুনাম রয়েছে। সেটি হচ্ছে রংপুরের মানুষদের বলা হয় ‘সহজ-সরল’। এত বেশি সহজ-সরল আর অভাবী মানুষের ভিড়ে একটি বিখ্যাত পরিবারও রয়েছে এখানে। সেটি হলো ‘ভরসা পরিবার’। রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার নামে সমৃদ্ধ এ পরিবারের ইতিহাস।
রংপুরসহ সারা দেশের মানুষের কাছে রয়েছে এ দুই ভাইয়ের অন্যরকম পরিচিতি। তামাক ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া দুই ভাই রাজনীতিতেও ছিলেন সরব। সমাজের জন্য নিবেদিত হয়ে জাতীয় সংসদে রংপুরের মানুষের প্রতিনিধিত্বও করেছেন তারা। নিজেদের সম্পদে ‘গরিবের হক’ প্রতিষ্ঠা করতে দুই ভাই দুই হাত উজাড় করে দান করেছেন। গড়েছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসা আজ বেঁচে নেই। কিন্তু সগৌরবে বেঁচে আছে তাদের হাতে গড়া অনেক প্রতিষ্ঠান। যেখানে অর্ধ লাখেরও বেশি মানুষের রুজিরুটির হিসাব হয় প্রতিদিন। ‘গরিবের ভরসা’ হিসেবে মৃত্যুর পরও তারা লাখ লাখ মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
রংপুরসহ সারা দেশের মানুষের কাছে রয়েছে এ দুই ভাইয়ের অন্যরকম পরিচিতি। তামাক ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া দুই ভাই রাজনীতিতেও ছিলেন সরব। সমাজের জন্য নিবেদিত হয়ে জাতীয় সংসদে রংপুরের মানুষের প্রতিনিধিত্বও করেছেন তারা।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসাকে জানতে এবং পাঠকদের জানাতে ঘুরেছেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর শহর। রংপুর মহানগর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরের শহর হারাগাছ। সেখানকার সারাই ডারারপাড় এলাকার মনেরউদ্দিন পাইকার ও নবীজন নেছা দম্পতির ঘরে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন রহিম উদ্দিন ভরসা। পরের বছরই জন্ম হয় করিম উদ্দিন ভরসার। তারা ছিলেন দুই ভাই ও তিন বোন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী দুই ভাই জীবন সায়াহ্নে এসে বিভিন্ন রোগে ভুগেছেন। বয়সে দুই ভাই এক বছরের ছোট-বড় হলেও তাদের জীবন যবনিকা ঘটেছে দুই বছরের ব্যবধানে।
২০২০ সালের ১১ মার্চ ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রহিম উদ্দিন ভরসা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। চলতি (২০২২) বছরের ২৩ জুলাই রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করিম উদ্দিন ভরসার মৃত্যু হয়। তাদের মৃত্যুতে কেঁদেছে রংপুর। চিরদিনের জন্য আড়ালে চলে যাওয়া এ দুই ভাই নিজ বাসভবন লাগোয়া সারাই ডারারপাড় জামে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে মমতাময়ী মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
রহিম উদ্দিন ভরসা বিকশিত হতে হতে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছিলেন। পরিণত হয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে। শিল্পপতি, সমাজসেবী, দানশীল, শিক্ষানুরাগী ও জনবান্ধব রাজনীতিক ছিলেন তিনি। এসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন রংপুর তথা উত্তরবঙ্গের শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রণী পুরুষ। রংপুরের আধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক যুগের আলোর প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রহিম উদ্দিন ভরসা বিকশিত হতে হতে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছিলেন। পরিণত হয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে। শিল্পপতি, সমাজসেবী, দানশীল, শিক্ষানুরাগী ও জনবান্ধব রাজনীতিক ছিলেন তিনি। এসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন রংপুর তথা উত্তরবঙ্গের শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রণী পুরুষ। রংপুরের আধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক যুগের আলোর প্রতিষ্ঠাতা।
বড় ভাইয়ের মতোই ছিলেন ছোট ভাই করিম উদ্দিন ভরসা। অধিকাংশ মানুষ দুজনকে ‘ভরসা চাচা’ বলে সম্বোধন করতেন। তাদের দীর্ঘ ও উদাহরণতুল্য জীবনগল্প আর আলোকিত কর্মযজ্ঞ এখনও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
ছোটবেলা থেকেই রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসা খুব ছোট পরিসরে তামাকের ব্যবসা শুরু করেন। পরে স্থাপন করেন বিড়ির কারখানা। ভাগ্য বরাবরই তাদের ওপর সদয় ছিল। তরতরিয়ে এগোতে থাকে ব্যবসা। ছোট থেকে মাঝারি। মাঝারি থেকে বড়। বড় থেকে আরও বড় এবং এক থেকে একাধিক ব্যবসা ও শিল্পকারখানা স্থাপন করতে থাকেন। ব্যবসার গণ্ডি রংপুর থেকে উত্তরাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিড়ি থেকে শুরু করে একে একে জুট, ফ্যান, ম্যাচ, অয়েল, কয়েল, নারকেল তেল, একাধিক কোল্ড স্টোরেজ, ন্যাশনাল টোব্যাকো ইত্যাদি শিল্পকারখানা স্থাপন করেন। এছাড়া ব্যবসা বিস্তারে ছিল আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। এর সঙ্গে বিভিন্ন বড় বড় শিল্প, ব্যবসা ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালক এবং বড় উদ্যোক্তা শেয়ারের মালিকানাও নেন তারা।
রংপুরের গুণী লেখক ও সংগঠক রানা মাসুদের আলোর দীপ বই থেকে জানা যায়, ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে প্রথম অংশ নেন রহিম উদ্দিন ভরসা। পরবর্তীতে তিনি ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবা ও রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে হারাগাছ-কাউনিয়া-পীরগাছা (রংপুর- ৪) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, বিভিন্ন লোভনীয় হাতছানি সত্ত্বেও বিএনপির রাজনীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তার পুরো রাজনীতি ছিল বিএনপিকে ঘিরে।
তিনি কাউনিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি, রংপুর জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি, পরবর্তীতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন।
শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার, মানবকল্যাণ ও সমাজসেবায় বিপুল অবদানের জন্য রহিম উদ্দিন ভরসা বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক। এছাড়া আয়কর প্রদানের জন্য তিনি ভিআইপি সম্মাননাও লাভ করেন।
আলোর দীপে আরও বলা হয়, শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার, মানবকল্যাণ ও সমাজসেবায় বিপুল অবদানের জন্য রহিম উদ্দিন ভরসা বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক। এছাড়া আয়কর প্রদানের জন্য তিনি ভিআইপি সম্মাননাও লাভ করেন।
ভরসা যেন আজন্ম মানবদরদি। মানুষের বিভিন্ন উপকারে তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুস্থ মানুষের মাঝে তার সাহায্য ও সহযোগিতা পৌঁছে যেত। বিয়ে, পড়াশোনা, চিকিৎসা, ফসল আবাদ, চাকরি ও কর্মসংস্থান, সব ব্যাপারে তার দানের ভাণ্ডার ছিল অনেক বড়। বাদ যেত না কোনো সংগঠন ও কোনো খেলোয়াড়ও।
ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক হারাগাছের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। চেষ্টা করেন বিভিন্ন কারণে আলোচিত ও আলোকিত মানুষ হিসেবে সর্বজনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার জীবনগল্প জানার। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, উত্তরবঙ্গে একসময় ভরসা পরিবারের বিড়ি একচেটিয়া বাজার দখল করে। ব্যবসা যখন বড় হয়, তখন বাড়তে থাকে এ পরিবারের পরিচিতি, পরিধি আর উত্তরাধিকার। সঙ্গে সম্পদের পাহাড় আর সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডও চলতে থাকে। ফলে বড় ভাই রহিম উদ্দিন ভরসার অনুকরণীয় ছোট ভাই করিম উদ্দিন ভরসাও হয়ে উঠেন জনপ্রিয়। এমনটি জানান এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী জহুরুল হক।
হারাগাছ ভূমি অফিসের পাশে দাঁড়িয়ে আলাপচারিতায় এ ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসা একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। প্রতিষ্ঠান গড়া থেকে শুরু করে আয়ের পথ প্রসারিত করতে তারা একসঙ্গে ছিলেন। রহিম উদ্দিন ভরসা প্রথমে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। সারা বাংলাদেশে তার একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি হয়। রংপুর বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তিনি অঢেল সম্পদ গড়ে তোলেন। রহিম উদ্দিন ভরসা যা করেছেন, সবকিছুতে করিম উদ্দিন ভরসা সঙ্গে ছিলেন। এ কারণে দুই ভাই সারা দেশে ‘ভরসা’ নামে পরিচিতি পান।
৭২ বছর বয়সী জহুরুল হক আরও বলেন, জন্মস্থান অর্থাৎ হারাগাছের জন্য দুই ভাই অনেক কিছু করেছেন। এখানে তাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। রহিম উদ্দিন ভরসা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংসদ সদস্য ছিলেন। এরশাদের হাত ধরে রাজনীতিতে এসে তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন করিম উদ্দিন ভরসা। দুই ভাইয়ের মধ্যে রহিম উদ্দিন ভরসা এলাকায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, মাতৃসদন, মাদ্রাসা, এতিমখানা, মসজিদসহ অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ছোট ভাই করিম উদ্দিন ভরসাও অনেক জনসেবামূলক কাজ করেছেন। এখন দুই ভাই নেই। কিন্তু তাদের ছেলে-মেয়েরা রয়েছেন। তারাও বাবা-চাচার মতো মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবেন— এমন প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
‘এলাকার উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ সারা দেশে হারাগাছের বর্তমান পরিচিতির কারিগর হিসেবে রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসাকে মানুষ আজীবন মনে রাখবে’— এমন দাবি করেন স্থানীয় সাংবাদিক ও হারাগাছ প্রেসক্লাবের সভাপতি আয়নাল হক। ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে তিনি বলেন, দুই ভাই হারাগাছসহ বৃহত্তর রংপুরের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা বিশাল। রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার হাত ধরে হারাগাছে বিড়িশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কলকারখানাতে অর্ধলাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
পীরগাছায় রহিম উদ্দিন ভরসা মহিলা কলেজ, হারাগাছে রহিম উদ্দিন ভরসা কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানা, ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হারাগাছ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, হারাগাছ ফায়ার সার্ভিস, মনেরউদ্দিন দাতব্য হাসপাতাল, নবীজন নেছা দ্বি-মুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, হারাগাছ সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। পাশাপাশি অর্থায়ন ও জমিদানে অবদান রয়েছে রহিম উদ্দিন ভরসার। শুধু হারাগাছেই নয়, পীরগাছা-কাউনিয়া, গঙ্গাচড়াসহ বৃহত্তর রংপুরে তাদের দুই ভাইয়ের অনেক অবদান রয়েছে। সাহায্যের জন্য কেউ গিয়ে কখনও খালি হাতে ফিরে আসেননি। গরিব ও দুঃখী মানুষের জন্য তারা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।’
হারাগাছের দালালহাট এলাকার নবীন ব্যবসায়ী সাগর মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ প্রজন্মের যারা ব্যবসায়ী, তাদের অনুপ্রেরণা ও সাহসের নাম রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসা। অত্যন্ত গরিব ঘরের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তারা দুই ভাই আলোকিত ব্যবসায়ী ছিলেন। মা ছিলেন রত্নগর্ভা। মা হিসেবে সন্তানদের যে ‘ভরসা’ নাম দিয়েছিলেন, তা দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে কীভাবে বড় হওয়া যায়, তার প্রতীক ছিলেন দুই ভাই। রংপুরে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন কিন্তু নবীনদের জন্য তারা হলেন অনুপ্রেরণা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের উন্নয়ন, রাজনীতি ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাইফুল ইসলাম মানিক। তার ভাষ্য মতে, দুই ভাইয়ের অটুট সম্পর্ক ও মেলবন্ধন ছিল অকল্পনীয়। গরিব থেকে ধনী হলে মানুষের মধ্যে অর্থের প্রতি যে লোভ-লালসা তৈরি হয়, তা ছুঁতে পারেনি দুজনকে।
সেই স্মৃতি তুলে ধরে হারাগাছ পৌরসভার সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম মানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশ স্বাধীনের আগে উনাদের (ভরসা পরিবার) অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। স্বাধীনতার পর তারা আস্তে আস্তে পয়সাওয়ালা হতে থাকেন। তাদের মধ্যে কোনো অহমিকা ছিল না। খুবই দানবীর ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। হারাগাছের পরিবর্তন দুই ভাইয়ের হাত ধরেই শুরু হয়।
‘করিম উদ্দিন ভরসা চাচার সঙ্গে খুব বেশি মেশার সুযোগ হয়নি। কিন্তু তার বড় ভাই রহিম উদ্দিন ভরসা চাচার সঙ্গে আমার অন্যরকম সম্পর্ক ছিল। এমন মহান ও দূরদর্শী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। রহিম উদ্দিন ভরসা চাচা খুব অল্প কথাতেই মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝতেন। হারাগাছের প্রতিটি মানুষকে তারা নিজেদের সন্তানের মতো দেখতেন। দল ও মত সবার কাছে তাদের ছিল অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা। মানুষ হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন তারা। সারা দেশে ভরসা পরিবারের একটা আলাদা খ্যাতি রয়েছে। আজ তাদের শূন্যতা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’
ভরসা পরিবারেরই একজন আমিন উদ্দিন বিএসসি। সম্পর্কে তিনি রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার ফুফাতো ভাই। আমিন উদ্দিন বিএসসি বৃহত্তর রংপুরের বিড়ি শ্রমিকদের খুব কাছের এক নেতা। তামাকের ব্যবসা, বিড়িশিল্পের প্রসারসহ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সবসময় মাঠে থাকেন। শত ব্যস্ততার মধ্যে একবার হলেও ভরসা বাড়িতে এসে ঘুরে যান তিনি। এ পরিবারের সঙ্গে তার রয়েছে আত্মীয়তার বন্ধন। এ কারণে রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার জীবনগল্পের অনেক কথাই তার নখদর্পণে।
হারাগাছ পৌরসভার চেয়ারম্যানটারী এলাকায় বসে আলাপকালে আমিন উদ্দিন বিএসসি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রহিম উদ্দিন ভরসা ছোটবেলা তার মামার নুরজাহান বিড়ির কারখানাতে চাকরি করতেন। সম্ভবত পাঁচ-সাত বছর সেখানে চাকরি করেন। পরে চাকরি ছেড়ে তিনি নিজেই ব্যবসা করার চেষ্টা করেন। তখন তার হাতে আড়াই অথবা তিন টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়ে রহিম উদ্দিন ভরসা খুব ছোট পরিসরে তামাকের ব্যবসা শুরু করেন। এটা সম্ভবত ১৯৪৭-৪৮ সালের দিকের ঘটনা।
‘রহিম উদ্দিন ভরসা রংপুর নগরীর বর্তমান বেতপট্টিস্থ মোড়ে এক হিন্দু দোকানদারের সহযোগিতায় তার বারান্দার সামনে বসে গুঁড়া তামাক বেচা শুরু করেন। পরে দোকানের মালিক ভারতে চলে যাবার সময় রহিম উদ্দিন ভরসার কাছে দোকানটি বিক্রি করে দেন। দোকানটি কিনে সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পান রহিম উদ্দিন ভরসা। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে ওই দোকানে তামাকের ব্যবসা দিয়ে তার উত্থান শুরু।’
আমিন উদ্দিন বিএসসি বলেন, ছোট ওই দোকান থেকে ধাপে ধাপে রহিম উদ্দিন ভরসা ব্যবসা বড় করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি বিড়ির কারখানা গড়েন। প্রথমে ছিল তাজ বিড়ি, পরে আজিজ বিড়ি করেন। ওই সময়ে পাতার রমরমা ব্যবসা ছিল। তিনি ভারত থেকে ট্যাংকু পাতা আমদানি করতেন। জড়ান পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। সেটা ৬০ সালের আগের কথা। এভাবে রহিম উদ্দিন ভরসার ব্যবসা বাড়তে থাকে। তার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, ব্যবসার শুরু থেকেই তিনি দুহাতে মানুষকে দান করতেন। সবার সঙ্গে চলাফেরা করতেন। সামাজিক কাজগুলোতে সবার আগে এগিয়ে যাওয়া, তার অন্যরকম স্পৃহা ছিল।
‘রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার ব্যবসায়িক উন্নতির পালে হাওয়া লাগে দেশ স্বাধীনের পর থেকে। তখন তাদের বিড়িশিল্প থেকে শুরু করে অন্যান্য কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু হয়। এগুলো শুধু রংপুরকেন্দ্রিক ছিল না। স্থানীয় পর্যায় ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কলকারখানা গড়ে তোলেন তারা।’
শুধু ব্যবসা ও সমাজসেবা নিয়েই পড়েছিলেন না দুই ভাই। মানুষের জন্য সংসদে দাঁড়িয়েও কথা বলেছেন। দুই ভাই বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলাকায় অভাবনীয় উন্নয়নের সূচনা করেছিলেন— বলেন আমিন উদ্দিন বিএসসি।
লুঙ্গির প্রতি রহিম উদ্দিন ভরসার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। লুঙ্গি পরেই সর্বত্র বিচরণ ছিল তার। এ নিয়ে আলোচিত এক ঘটনার কথা উল্লেখ করেন এ শ্রমিক নেতা। বলেন, রহিম উদ্দিন ভরসা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত এবং এ অঞ্চলে বিএনপিকে সুসংগঠিত করতে তার অবদান ছিল অনেক। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পান। তখনও তিনি লুঙ্গি পরে চলাফেরা করতেন।
‘রংপুরে তখন (সম্ভবত ১৯৭৯ সাল) মোটরসাইকেলের শোরুম ছিল না। রহিম উদ্দিন ভরসা ব্যবসার কাজে রংপুর ও ঢাকায় থাকতেন। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে কর্মীদের ব্যবহারের জন্য মোটরসাইকেল কিনতে ঢাকার একটি বড় শোরুমে যান তিনি। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। এ অবস্থায় দেখে শোরুমের লোকজন তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তার আঞ্চলিক কথাবার্তা শুনে শোরুমের লোকেরা তাকে তাচ্ছিল্য করেছিল। বলেছিল, আপনি এত দামি মোটরসাইকেল কিনতে পারবেন তো! একথা শুনে ভরসা একটু রাগান্বিত হন। পরে শোরুম ও গোডাউনে থাকা সবগুলো মোটরসাইকেল একসঙ্গে কিনে নিতে চান। একথা শুনে শোরুমের সবাই অবাক। শেষ পর্যন্ত রহিম উদ্দিন ভরসা সেখান থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫০ থেকে ৬০টি মোটরসাইকেল কিনে ট্রাকে করে হারাগাছে পৌঁছান।’
কথা হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। রহিম উদ্দিন ভরসার সঙ্গে চলাফেরার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ভরসা নামের পেছনেও একটা গল্প আছে। এটা রহিম উদ্দিন তার মা নবীজন নেছার কাছ থেকে শুনে আমাদের বলেছিলেন। তখন আমরা একসঙ্গে উঠা-বসা করতাম। রহিম উদ্দিন জন্মের পর থেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অনেক চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু বাঁচার কথা ছিল না। তখন তার মা নবীজন নেছা রহিম উদ্দিনকে আল্লাহর নামে ‘ভরসা’ করে সফে দেন। আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন— এ বিশ্বাস থেকে সবসময় দোয়া করতেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে রহিম উদ্দিন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। তখন থেকে মা রহিম উদ্দিনকে ‘ভরসা’ নামে ডাকতে শুরু করেন। এভাবেই তার নামের সঙ্গে ভরসা ডাক নাম ছড়িয়ে পড়ে।
জাতীয় সংসদের সদস্য থাকাকালীন কোনো এক অধিবেশনে জাতীয় পার্টির এমপি হিসেবে করিম উদ্দিন ভরসা রাস্তা প্রশস্তকরণে স্পিকারের কাছে দাবি জানান। কিন্তু দাবি উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে সংসদে হাস্যরস তৈরি হয়। যা তৎকালীন সাধারণ মানুষের কাছেও ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। অথচ করিম উদ্দিন ভরসার আঞ্চলিকতা নিয়ে এখনও গর্ববোধ করেন হারাগাছসহ রংপুর অঞ্চলের মানুষ।
কারণ হিসেবে রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বাংলাদেশি, বাঙালি এবং আমাদের ভাষা বাংলা। কিন্তু আমাদের সবারই নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। করিম উদ্দিন ভরসা সেই আঞ্চলিকতার বাইরের কেউ নন। তিনি নিজ ভাষাতেই বেশির ভাগ সময় কথা বলতেন। সংসদেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি সংসদে বলেছিলেন, ‘হামার সরু আস্তাটা (রাস্তাটা) চ্যাপ্টা করি দাও বাহে স্পিকার’।
রহিম উদ্দিন ভরসা তার মায়ের নামে হারাগাছে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এক সময়ের অবহেলিত এ জনপদে নারীরা শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে ছিল। ঘরবন্দি জীবদ্দশায় খুব কম পরিবারে শিক্ষার আলো পড়ত। বিশেষ করে বিড়িশিল্পখ্যাত হারাগাছ তখনও শিক্ষার প্রসারে পিছিয়ে ছিল। এ পরিস্থিতিতে আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভাব হয় ভরসা পরিবার।
রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার অবদানকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তাদের হাত ধরেই দিন বদলের আলো এসেছে হারাগাছে। সেই কথাই বলছিলেন নবীজন নেছা দ্বি-মুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল কাশেম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুই ভাই ছিলেন সাধারণ এক পরিবারের সন্তান। তামাক দিয়ে শুরু করা ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে ক্রমান্বয়ে রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসা বিড়ি ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিশেষ করে সত্তর দশকের পর তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্তৃত হয়। তাদের গুলশান, আরমানিটোলা, বেগম বাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বাড়ি আছে। ভরসা পরিবারের সন্তানদের অনেকেই বিদেশে অবস্থান করছেন। তবে সবাই ব্যবসাবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’
‘হারাগাছ সরকারি কলেজ, নবীজন নেছা দ্বি-মুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ এলাকার শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের যে অবদান, তা ভুলে যাবার নয়। শিক্ষার বিস্তারে তারা দুই ভাই যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। হারাগাছের মানুষের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণে তেমন আগ্রহ ছিল না। মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্য দুই ভাই আমৃত্যু কাজ করেছেন। হারাগাছে কোনো বালিকা বিদ্যালয় না থাকায় তারা বাড়ির সামনের এক গোডাউনে বিদ্যালয় চালু করেন। পরে সেখান থেকে বড় পরিসরে বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে একটার পর একটা স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়তে তারা অকাতরে দান করে গেছেন।’
হারাগাছে বর্তমানে দুটি কলেজ, আটটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি বেসরকারি প্রাথমিক ও পাঁচটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাদ্রাসা এবং চারটি এতিমখানা রয়েছে। সবগুলোতেই কম-বেশি ভরসা পরিবারের অবদান রয়েছে।
এ নিয়ে নবীজন নেছা দ্বি-মুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এস এম নুরুন্নবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৮২ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। রহিম উদ্দিন ভরসার উদ্যোগ ও চেষ্টার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আজও টিকে আছে। এখান থেকে শত শত মেয়ে পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। বর্তমানে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে তিনশো শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। এর পাশে একই নামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। শুধু হারাগাছে নয়, শিক্ষার বিস্তারে পীরগাছা, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়াসহ রংপুর অঞ্চলে ভরসা পরিবারের বিশেষ অবদান রয়েছে।
দীর্ঘ ২৩ বছর রহিম উদ্দিন ভরসার বাসায় কাজ করেছেন মোছলেম উদ্দিন। এখন বয়স ৬৮। তিনি হারাগাছের চেয়ারম্যানটারি এলাকার বাসিন্দা। খুব কাছ থেকে রহিম উদ্দিন ও করিম উদ্দিন ভরসার ব্যবসা-বাণিজ্য, চলাফেরা ও কর্মকাণ্ড দেখেছেন। ভরসা পরিবারের হাত ধরে বদলে গেছে তার জীবনও। সন্তানদের পড়ালেখা, সংসার চালানো, বাড়ি-ঘর নির্মাণসহ যা যা করেছেন সবকিছুতেই রয়েছে ভরসা পরিবারের অবদান—জানান তিনি।
তার ভাষায়, দুই ভাই হারাগাছের রত্ন। তাদের সুনাম শুধু উত্তরাঞ্চলে নয়, সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে। ধন-সম্পদ ও মনে তারা হারাগাছের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। আমার কাছে তারা ছিলেন শিক্ষকের মতো। এমনভাবে যেকোনো বিষয় সহজে বুঝাতেন, আমার বাবাও কখনও সেভাবে বোঝাতে পারেননি। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
রংপুর মহানগর ছেড়ে হারাগাছ পৌর এলাকায় যেতেই চোখে পড়বে আলহাজ রহিম উদ্দিন ভরসা কওমি মাদরাসা ও এতিমখানা। ২১ বছর আগে মা নবীজন নেছাকে দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রহিম উদ্দিন ভরসা। এরপর থেকে শত শত শিক্ষার্থী এখান থেকে কোরআনের আলো সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ভরসা পরিবারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত এ মাদ্রাসায় বর্তমানে এতিম শিশুসহ তিন শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
রহিম উদ্দিন ভরসা কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষা সচিব মুফতি শাহাদত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভরসা পরিবারের দান, সদকা, সমাজসেবামূলক কাজের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে রহিম উদ্দিন ভরসা অনেকগুলো স্কুল, কলেজ, মসজিদ নির্মাণে দান-সদকা করে গেছেন। আবার কোনো কোনোটি উনি সরাসরি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এগুলোর মধ্যে মাদ্রাসার বিষয়টি একটু ভিন্ন। কারণ, এটি বড় সদকায়ে জারিয়া। শুধু রহিম উদ্দিন ভরসা মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেই থেমে যাননি। তার মৃত্যুর পরও ভরসা পরিবার থেকে মাদ্রাসা পরিচালনায় বিপুল পরিমাণ অর্থ দান-সদকা ও এতিমদের সাহায্য করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, এটা আশাতীত। এমনটা বাংলাদেশে খুব কম দেখা যায়।
হারাগাছ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে তিস্তা নদী। সত্তর দশকের শেষদিকে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে একবার বন্যায় নদী ভাঙতে ভাঙতে তিস্তার পানি ধেয়ে এসেছিল হারাগাছের দিকে। হুমকির মুখে পড়েছিল সেখানকার ঐতিহ্যবাহী সাদা মসজিদ। বিলীন হয়ে যায় লাল মসজিদ। ওই সময় রহিম উদ্দিন ভরসার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও চেষ্টার কারণে অরক্ষিত হারাগাছ তিস্তার গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে স্থানীয় তামাক ব্যবসায়ী এজাজুল হক বলেন, হারাগাছ রক্ষায় রহিম উদ্দিন ভরসার অবদান এখানকার মানুষ আজীবন মনে রাখবে। ওই সময়ে সাদা মসজিদ রক্ষায় স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে তিনি জরুরিভিত্তিতে বস্তা ও বোল্ডার ফেলাসহ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা আজও স্মরণীয়। ভাঙন ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হেলিকপ্টারে করে হারাগাছে নিয়ে আসেন। এরপর পুরো ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে জরুরি ভিত্তিতে হারাগাছ রক্ষায় ব্যবস্থা নেন। সেদিন যদি রহিম উদ্দিন ভরসা তৎপর না হতেন তাহলে আজকের হারাগাছ আমরা পেতাম না। তিস্তা নদীর ভাঙনে তখনই বিলীন হয়ে যেত।
কথা হয় ভরসা পরিবারের গাড়িচালক আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রায় ১৯ বছর ধরে এ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘ ১৭ বছর রহিম উদ্দিন ভরসাকে গাড়িতে নিয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়িয়েছেন। রহিম উদ্দিন ভরসা যখন অসুস্থ হয়ে দেশ-বিদেশে শয্যাশায়ী তখনও আস্থার মানুষ হিসেবে তার পাশে থেকে সেবাযত্ন করেছেন। সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও চোখ ভিজে যায় আমজাদের। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। কারণ, তার শৈশব, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া আর গাড়ি চালানো— সবই সম্ভব হয়েছে রহিম উদ্দিন ভরসার কারণে। তার বাবাও একসময় ভরসা পরিবারে চাকরি করতেন।
আমজাদ হোসেন বলেন, ‘ভরসা চাচা আমাকে বাবার স্নেহে বড় করেছেন। আমি অন্য জায়গায় চাকরি করতাম। তখনও গাড়ি চালানো জানতাম না। চাচা আমাকে সেখানে থেকে নিয়ে এসে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। তার এখানে চাকরির ব্যবস্থা করেন। ছোটবেলা থেকেই চাচাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে। এরকম সাদা মনের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তিনি হারাগাছের সব দল ও মতের মানুষের নেতা ছিলেন। ভরসা চাচা বিএনপির রাজনীতি করলেও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ সব দলের নেতাকর্মীদের জন্য কাজ করেছেন। কাউকে কখনও নিরাশ করেননি।’
‘আমার জন্মস্থান গাইবান্ধা। সেখানেই একসময় থাকতাম। পরে চাচার মাধ্যমে রংপুরে বসবাস শুরু করি। ভরসা চাচাই আমার থাকা-খাওয়া, সংসার চালানোর ব্যবস্থা করে দেন। শুধু তা-ই নয়, রংপুর শহরে জায়গা কিনে দেন, বাড়ি নির্মাণ করে দেন। তার এ অবদান আমি, আমার পরিবার কোনো দিনও অস্বীকার করতে পারব না।’
রংপুরের আলমনগরে করিম উদ্দিন ভরসার প্রতিষ্ঠিত আরকে ফ্যান ফ্যাক্টরিতে স্টোর ইনচার্জ হিসেবে নব্বইয়ের দশকে চাকরি করতেন সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পী। বর্তমানে তিনি সাংবাদিকতা করছেন। রংপুর প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পী বলেন, করিম উদ্দিন ভরসা চাচা ছিলেন অন্যরকম মানুষ। উনি প্রতি মাসে ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে আসতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে ডেকে নিয়ে ফ্যাক্টরির পাশের একটা মাঠে বসতেন। কখনও তাকে চেয়ারে বসতে দেখিনি। উনি মাসের এক তারিখের মধ্যে আমাদের বেতন দিয়ে দিতেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল।
‘রংপুর যতদিন আছে ততদিন রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসাকে মানুষ মনে রাখবে। বিশেষ করে দুই ভাইয়ের মানবিকতা, উদারতা ও সহযোগিতার যে দৃষ্টান্ত, তা কখনও ভুলে যাবার নয়। এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাদের সান্নিধ্যে কাজ করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি।’
রাজনীতির মাঠে করিম উদ্দিন ভরসাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন রংপুরের সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি মাহবুব রহমান হাবু। তাকে নিয়ে একাধিক রিপোর্টও করেছেন তিনি। ভীষণ সাহসী, নির্ভীক, নির্লোভ ও জনবান্ধব নেতা হিসেবে করিম উদ্দিন ভরসার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবার কাছে।
১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে রংপুর- ১ (গঙ্গাচড়া) আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে রংপুর- ৪ (হারাগাছ-কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। করিম উদ্দিন ভরসা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
করিম উদ্দিন ভরসার সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের তুলনা করে মাহবুব রহমান হাবু বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে নির্বাচিত হয়েই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু করিম উদ্দিন ভরসা এবং তার বড় ভাই রহিম উদ্দিন ভরসার বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ কখনও আমরা শুনিনি। তারা রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করেননি, লুটও করেননি। তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েও কখনও বিদেশে অর্থ পাচার করেননি। বরং নিজেদের সম্পদ ও অর্থ মানুষের কল্যাণে বিলিয়েছেন। তাদের রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের বড় পার্থক্য এটি।
পরিবার ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রহিম উদ্দিন ভরসার দুই সংসারে ছয় ছেলে ও নয় মেয়ে রয়েছেন। মেয়েদের সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয়েছে এবং তারা এখন নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেরা আরভি গ্রুপের সাম্রাজ্য দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বড় ছেলে আজিজুল হক ভরসা আরভি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এরশাদুল হক ভরসা, এমদাদুল হক ভরসা, একরামুল হক ভরসা, আকতারুল হক ভরসা যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান হিসেবে এ শিল্পগ্রুপসহ অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার এক ছেলে আশরাফুল হক ভরসা ইন্তেকাল করেছেন। অন্যদিকে, করিম উদ্দিন ভরসার দুই স্ত্রীর ঘরে ১০ ছেলে ও ছয় মেয়ে রয়েছে।
বর্তমানে ভরসা পরিবারের অনেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ রাজধানী ঢাকায় থাকেন। এ কারণে তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হারাগাছে রহিম উদ্দিন ভরসার দুই ছেলের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা আপত্তি জানান। অন্যদিকে, করিম উদ্দিন ভরসার সন্তানরা অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন।
এমএআর/এমএএস/আরএআর