‘না খেয়ে মরার চেয়ে আন্দোলন করে মরা ভালো’
দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন চা-শ্রমিকরা। তাছাড়া চা-শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির অষ্টম দিন চলছে আজ (২০ আগস্ট)। হবিগঞ্জের ২৪টি চা বাগানে মিছিল-সমাবেশে প্রকম্পিত করে তুলেছেন শ্রমিকরা।
দুপুর ১২টার দিকে বাহুবলের সাতটি বাগানের শ্রমিকরা বাগানবাড়ি নামক স্থানে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের আহ্বানে পৌনে ১ ঘণ্টা পর শ্রমিকরা মহাসড়ক ত্যাগ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠকে বসেন।
মহাসড়ক অবরোধে মধুপুর, রশিদপুর, বৃন্দাবন, দারাগাও, কামাইছড়াসহ আরও দুটি বাগানের শ্রমিকরা অংশ নেন। এ সময় নেতৃবৃন্দ ৩০০ টাকা মজুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
তারা বলেন, গত বুধবার (১৭ আগস্ট) ঢাকায় শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে বৈঠকে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে তামাশা করেছে।
বাহুবল মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) প্রজিত কুমার জানান, চা-শ্রমিকরা দুপুর ১২টার দিকে মহাসড়কে অবস্থান নেন। এ সময় দুই দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। এক সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুরোধে মহাসড়ক ত্যাগ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন শ্রমিকরা।
এদিকে চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলার বাগানগুলোতে সকাল থেকেই বিক্ষোভ মিছিল করছেন শ্রমিকরা। সকাল ৮টা থেকে চুনারুঘাটের চান্দপুর, বেগমখান, লস্করপুর, সাতছড়ি, দেউন্দি, নালুয়া, আমু, চণ্ডিছড়া, নালমুখ, রেমা, চাকলাপুঞ্জি ও মাধবপুরের সুরমা, তেলিয়াপাড়া, নোয়াপাড়া, জগদীশপুর ও বৈকুণ্ঠপুর চা-বাগান স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল করে তুলেছেন শ্রমিকরা।
চুনারুঘাটের চান্দপুর চা বাগানের শ্রমিক ও বাংলাদেশ চা-শ্রমিক কন্যা সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সন্ধ্যা রানী ভৌমিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তিনি যেন চা বাগানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের ৩০০ টাকা মজুরি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আমরা হাড়ভাঙা খাটুনির পরও মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পাই। এই টাকা দিয়ে নিজের পেটেই ভাত হয় না। আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর টাকার অভাবে আর পড়াশোনা করাতে পারি না। ফলে বংশ পরম্পরায় আমরা চা-বাগানের ভেতরই আটকে থাকি। পড়াশোনা করে আমাদের সন্তানরা কখনো মানুষের মত মানুষ হতে পারবে না।
তেলিয়াপাড়া চা বাগান নারী শ্রমিক স্বপ্না বাউরি বলেন, আমরা দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছি। ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে আমাদের পোষায় না। আমরা সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে ৬শ/৭শ টাকা পাই। যা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা, এক কেজি আলুর দাম ৪০ টাকা। ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে আমাদের হয় না। তাই ৩০০ টাকা মজুরি না হলে আমরা ধর্মঘট চালিয়ে যাব। এভাবে না খেয়ে মরার চেয়ে আন্দোলন করে মরা ভালো।
তেলিয়াপাড়া চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি খোকন তাঁতী বলেন, আজ প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট করছি। কিন্তু মালিকপক্ষ ও সরকার কোন কথা বলছে না। চা বাগানের লোকজন নিরীহ বলে আমাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। তাই যতদিন পর্যন্ত ৩০০ টাকা মজুরির দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা ধর্মঘট চালিয়ে যাব। এই শোকাহত আগস্ট মাসে আমাদের আন্দোলন করার কথা না। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বলেই আন্দোলনে নামতে হয়েছে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নৃপেন পাল বলেন, চা বাগানের প্রতিটি মানুষের একটাই দাবি- তা হলো দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। শ্রমিকরা না খেয়ে মরে যাচ্ছে, আর মালিকরা আমাদের দাবিকে তামাশা হিসেবে দেখছে। শ্রম অধিদপ্তরের লোকজন মালিকপক্ষের হয়ে কথা বলছেন। তাই আমরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি না পাওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকব। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমরা এই দাবি আদায় করব।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের বৈঠক হয়। সেখানে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব দেন শ্রমিক নেতারা। কিন্তু মালিকপক্ষ ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩৪ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। যে কারণে শ্রমিক নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর আরও এক মাস পেরিয়ে যায়, মালিকপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এর প্রতিবাদে ৯ থেকে ১২ আগস্ট মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত টানা চার দিন প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ধর্মঘট পালন করা হয়। তারপরও মালিকপক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কথা না বলায় ১৩ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সকল চা-বাগানে শুরু হয় শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের পূর্ণদিবস কর্মবিরতি।
আরএআর