রোগীর মৃত্যুর পর চিকিৎসার জন্য আসে সমাজসেবার অর্থ
ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, প্যারালাইজড, হৃদরোগসহ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতদরিদ্র মানুষদের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু এই অর্থপ্রাপ্তিতে আবেদনকারীদের দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয়। নানাভাবে হয়রানি, বিড়ম্বনা আর কালক্ষেপণের কারণে অনেকেই সহায়তা পাওয়ার আগেই অর্থাভাবে পাড়ি জমাচ্ছেন না ফেরার দেশে।
সম্প্রতি রংপুর সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে ভুক্তভোগী বেশ কিছু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও কালক্ষেপণের জন্য সমাজসেবার কর্মকর্তাদের অভিযোগের তীর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দিকে। সেখানেই আবেদনকারীদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে বিশি সময় লাগে বলে দাবি তাদের।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, চিকিৎসার জন্য সময়মতো সরকারের আর্থিক সহায়তার টাকা না পাওয়ায় রংপুর অঞ্চলে প্রতি মাসে অন্তত অর্ধশত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য দেরিতে আসা বরাদ্দ করা অর্থ রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয় নয়-ছয় করছেন বলেও দাবি তাদের।
রংপুর সদর উপজেলা পাগলাপীর দেবীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মজিদের মা জোবেদা বেগম লিভার সিরোসিস (ক্যানসার) রোগে আক্রান্ত হয় ২০২০ সালে। সমাজসেবায় আবেদন করেও সময়মতো চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা পাননি। শুধু অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারায় তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে আব্দুল মজিদ বলেন, আমার মায়ের চিকিৎসার জন্য ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে সমাজসেবার অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু অর্থাভাবে ঠিকমতো মায়ের চিকিৎসা করতে পারিনি। আবেদন করার সাত মাস পর আগস্টে আমার মায়ের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে অনেকবার সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।
আক্ষেপ করে এই ব্যক্তি বলেন, সমাজসেবা কার্যালয় গেলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করা হয়। অনুদানের চেক ইস্যু হলে তারাই নাকি যোগাযোগ করবে। আমার মায়ের মৃত্যুর এক বছর হতে চলছে। সমাজসেবা কার্যালয় থেকে কেউ ফোন করে খোঁজ নেয়নি। আমার মা বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছে, সেটাও তারা জানেন না। আমি নিজে থেকেই সমাজসেবা কর্মকর্তাকে আমার মায়ের কবরে ঘাস গজানোর কথা জানিয়েছি। মৃত্যুর কথা জানার পর থেকে বরাদ্দ করা অর্থ দিতে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। মৃত ব্যক্তির পরিবারকে নাকি টাকা দেওয়া হয় না, এ টাকা তারা ফেরত পাঠাবেন।
রংপুর মহানগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আশরাফ আনছারি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার মেয়ে আনজুমান আরা বেগম ২০২০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আমি সমাজসেবা কার্যালয়ে তাদের কথামতো ২০২১ সালে অনলাইনে আবেদন করেছি। আজ পর্যন্ত কোনো খবর আসেনি, এরই মধ্যে আমার মেয়েটা মারা গেছে।
এছাড়া ক্যানসারে আক্রান্ত রংপুর মহানগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দিনমজুর সাদেকুল ইসলামের বড় ভাই নাজমুল হক (৫৫) গত বছর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। সাদেকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার ভাইকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা ঢাকায় রেফার করলেও অর্থাভাবে ভাইকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে পারছি না। যদিও স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু সমাজসেবার অনলাইনে আবেদনের তিন মাস হচ্ছে, এখনো কোনো খবর নেই। মানুষ মরে গিয়ে কবরে ঘাস গজানোর পর টাকা এসে লাভ কী? সেই টাকা নিয়ে তো এখানে অনেক ঝামেলা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমার বড় ভাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। অন্যের জমিতে চালা ঘর করে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো রকমে বসবাস করে আসছে। হঠাৎ তিনি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে আজ পুরো পরিবার পথে বসেছে। সরকার যদি ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য তাড়াতাড়ি আর্থিক সহায়তার টাকাটা দিতে পারতেন, তাহলে আমি ভাইকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারতাম।
জানা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩ লাখ মানুষ ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, প্যারালাইজড, হৃদরোগসহ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্থের অভাবে এসব রোগে আক্রান্ত মানুষ যেন ধুঁকে ধুঁকে মারা না যায় এবং ব্যয় বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে না পড়ে, সেজন্য সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে হতদরিদ্র রোগীদের কিস্তি স্বরূপ দ্রুত এককালীন ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছেন। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের অন্য জেলাগুলোর মতো রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়েও বছরে শত শত মানুষ চিকিৎসা সহায়তার জন্য আবেদন পড়ছে। কিন্তু সময়মতো অর্থসহায়তা দিতে না পারায় ভুক্তভোগী মানুষদের মাঝে বাড়ছে ক্ষোভ, সঙ্গে জমা হচ্ছে বিড়ম্বনার ঝুড়ি ঝুড়ি অভিজ্ঞতা।
কেন এমনটা হচ্ছে, জানতে চাইলে রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের কার্যালয়ে প্রতি মাসে বিভিন্ন রোগের ক্যাটাগরিতে ৫ শতাধিক আবেদন জমা হচ্ছে। আমরা এসব আবেদন ফাইল করে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেই। তারা এসব আবেদন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা জুরি বোর্ডের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে তারপর আমাদের কার্যালয়ে আবার পাঠিয়ে দেন। এরপর আমরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তার চেক ইস্যু করি। এই প্রক্রিয়ার কারণে কখনো কখনো একটু বেশি সময় লাগে। তবে সব সময় এমনটা হয় না।
তিনি বলেন, প্রতি মাসে ৩০-৪০ জন রোগীর মৃত্যু হয়। এ মাসেও ২৫ রোগীর মৃত্যুর খবর শুনেছি। রংপুর অঞ্চলে বরাদ্দ অনেক কম থাকায় আমরা মারা যাওয়া ব্যক্তির চেয়ে জীবিত রোগীদের বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এজন্য ওই মৃত ব্যক্তির বরাদ্দ করা টাকা তার পরিবারকে না দিয়ে জীবিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয়। তবে সব রোগীদের ক্ষেত্রে এটা করা হয় না, কিছু কিছু অসহায় মৃত ব্যক্তির নমিনিদের হাতেও আমরা তাদের অনুদানের টাকা দিয়ে আসছি।
এদিকে সমাজসেবা কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রক্রিয়াগত কারণে সরকারের বরাদ্দ করা অর্থ সঠিক সময়ে না পাওয়ায় প্রতি মাসে আবেদনকারীদের মধ্য থেকে ৩০-৪০ জনের অধিক হতদরিদ্র মানুষ মারা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডা. শামীম আহমেদ বলেন, প্রতি মাসে ৫০০-৬০০ আবেদন দেখতে হয়। আমরা এগুলোকে অভিজ্ঞ চার চিকিৎসক দিয়ে যাচাই-বাছাই করে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করে থাকি। এ সকল আবেদনের ক্ষেত্রেও অনেক ভুল আবেদন থাকে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা একটু সময়ের ব্যাপার। তবে আমাদের অফিসে তেমন সময় অতিবাহিত হয় না। এটার অর্থ বরাদ্দ দেয় সমাজসেবা কার্যালয়, সময় অতিবাহিত হলে সেখানেই হতে পারে।
স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মোছা. জিলুফা সুলতানা বলেছেন, একজন হতদরিদ্র মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছেন। কিন্তু কালক্ষেপণের কারণে অর্থাভাবে চিকিৎসা না করাতে পেরে মৃত্যুর যে অভিযোগ উঠেছে, তা দুঃখজনক। দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থ বরাদ্দ হলে ভুক্তভোগীরা উপকৃত হবেন। তবে সময় অতিবাহিত হওয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এখন থেকে কীভাবে এ অর্থ সহজীকরণ করা যায়, তার ব্যবস্থা করা হবে।
এসপি