খেজুর চাষে ভাগ্য বদল বাদলের
নজরুল ইসলাম বাদল (৩০)। গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী ইউনিয়নের আলিমপাড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমান খানের ছেলে। ২০০৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্স করেন। পরে বেকারত্ব ঘোচাতে এনজিওসহ কয়েকটি টেলিকমিউনিকেশন সংস্থায় পরিবেশকের চাকরি করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। পরে সব কিছু বাদ দিয়ে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যোগ দেন। কৃষিকাজে নতুন সম্ভাবনার দিক খুঁজতে থাকেন। বর্তমানে তিনি একজন সফল কৃষক।
জানা গেছে, বাদল দেশ-বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের জমিতে ‘সৌদি ডেট পাম ট্রিস ইন বাংলাদেশ’ নামে খেজুরের বাগান গড়ে তোলেন। খেজুরের বাগানের পাশাপাশি খেজুর চারার নার্সারিও গড়ে তুলেছেন। খেজুর চাষ করে তিনি দেশে খেজুরের চাহিদা মেটানোর স্বপ্ন দেখছেন।
বাদলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাদল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্স করেন। এরপর কয়েক বছর চাকরি করেন। পরে কৃষক বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন। তখন থেকেই কৃষিতে নতুন কিছু করার চিন্তা-ভাবনা করেন। সেই ভাবনা তাকে নিয়ে যায় সৌদি আরব প্রবাসী এক বন্ধুর কাছে। ২০১৫ সালে শুরুর দিকে ওই বন্ধুর সহযোগিতায় খেজুরের চাষ ও নার্সারি করার পরিকল্পনা করেন।
মরুভূমি অঞ্চলের ফসল বাংলাদেশের মাটিতে ফলানো সম্ভব কি না তা নিয়েও তার ভাবনার অন্ত ছিল না। তারপরও প্রবাসী ওই বন্ধুর সহযোগিতায় বিশ্বের ৬টি দেশ থেকে বিভিন্ন জাতের খেজুরের বীজ ও চারা সংগ্রহ করেন বাদল। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমে ১৮টি চারা রোপণ করে মরুর খেজুরের চাষ শুরু করেন। এজন্য প্রথমেই তার খরচ হয় ৫২ লাখ টাকা।
প্রথমে ৭০ শতক জমিতে সৌদি আরবের খেজুরের জাত নিয়ে বাগান শুরু করেন। ২০১৭ সালে প্রথম তার বাগানের খেজুর গাছে ফলন আসতে শুরু করে। খেজুরের বীজ কিংবা সাকার থেকে চারা উৎপাদন করে খেজুরের নার্সারিও গড়ে তোলেন। সেই বছরেই বাগান থেকে ৬২ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার বাগানে ও নার্সারিতে ১৬ প্রজাতির খেজুর গাছ রয়েছে। তারপরও মানুষের ব্যাপক চাহিদার যোগান দিতে তিনি আরও ১৪ জাতের চারা বাইরে থেকে এনেছেন।
বর্তমানে নার্সারিসহ খেজুর বাগানটি সাড়ে ৭ বিঘায় সম্প্রসারিত করেছেন। সাকার থেকে উৎপাদিত চারায় ফলনের হার বেশি। সাকারের চারা রোপণের এক-দুই বছরের মধ্যেই খেজুর ধরে। এ ধরনের প্রতিটি সাকার ২৫ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর খেজুর ধরা অবস্থায়ও চারা বিক্রি করা হয়, যার দাম হলো ৩ লাখ টাকা। বাগান পরিচর্যা ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি মাসে তার ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়।
খেজুরচাষি নজরুল ইসলাম বাদল বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর বিভিন্ন জাতের ১৮টি গাছ রোপণ করেছিলাম। এ বছর বাগানে অনেক খেজুর ধরেছে। এক একটি খেজুরের বাধার ওজন প্রায় ২৫ কেজি।
তিনি আরও বলেন, ৩০ হাজার চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খেজুরের নার্সারি গড়ে তুলেছি। বাগানে খেজুরের যেসব জাত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আজওয়া, মরিয়ম, আম্বার, খুনিজি, হেলালি, ম্যাডজেলি, বারহি, খালাস, ওমানি, সুক্কারি, সাফাওয়ি। যেভাবে ফলন হচ্ছে তা ঠিক থাকলে অচিরেই দেশে খেজুরের চাহিদা মেটাতে পারব বলে আশা করছি।
টিস্যু, কলম (সাকার) ও সরাসরি বীজ থেকে উৎপাদিত হয় চারা। টিস্যু ও কলম চারা থেকে ১-২ বছরে ফলন পাওয়া যায়। একটি টিস্যু চারা ৮-১০ হাজার, কলম চারা ২৫-৫০ হাজার টাকা এবং বীজের চারা ৮০০-১০০০ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে।
একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ৮-১২টি বাধি ধরে। প্রতি বাধিতে ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে খেজুর হয়। তাছাড়া বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় ফলন আসতে সময় লাগে ৩-৪ বছর। বীজ থেকে উৎপাদিত চারার দাম তুলানামূলক কম। এখানে চারা ছাড়াও খেজুরও বিক্রি করা হয়।
দেশে বছরে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। যার পুরোটাই আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। দেশে খেজুর বাগান করতে সরকারের কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে আগামী ১০ বছরে দেশে উৎপাদিত খেজুরেই দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব বলেন বাদল। এক্ষেত্রে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারলে দেশে খেজুর চাষে হাজারো চাষি তৈরি হবে। কৃষকের মধ্যে খেজুর চারা সহজলভ্য ও কম মূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ হতে পারে খেজুর উৎপাদনের সম্ভাবনাময় দেশ।
ময়মনসিংহের ভালুকার পাঁচগাঁও এলাকার মাদরাসাশিক্ষক মো. বিল্লাল হোসেন জানান, ২০১৯ সালে তিনি গাজীপুরের নজরুল ইসলাম বাদলের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বারহী জাতের একটি এবং ৫০ হাজার টাকায় মরিয়ম জাতের একটি খেজুরের চারা কেনেন। বাদল ভাই নিজে এসে চারা দুটি তার জমিতে রোপণ করে দিয়ে গেছেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে খেজুর গাছে ফুল আসে, মার্চেই তা ফলে পরিণত হয়। তবে মরিয়ম খেজুর বারোমাসি হয়েছে।
তিনি বাদলের কাছ থেকে আবারো ৭৫ হাজার টাকায় একটি হেলালী, একটি আম্বার ও একটি খুদরি জাতের সাকারের কলম চারা ক্রয় করেছেন। চারাগুলো বাদল ভাই নিয়ে এসে আমার বাগানে লাগিয়ে দেবেন।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকার হাজী মমতাজ উদ্দিন জানান, তিনিও বাদলের কাছ থেকে চারা কিনেছেন। তাতে ভালো ফলন হচ্ছে। ২০২০ সালে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি দুটি খেজুর চারা ক্রয় করেছিলেন। ২১ মাস পরে এসব গাছে ফুল ও ফলন আসে। এখন খেজুরগুলো পরিপক্ব হয়েছে।
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায় ৬ মাস হলো গাজীপুরে যোগদান করেছি। তারপরও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামে প্রায় তিন বিঘা জমিতে সফলভাবে সৌদির খেজুর চাষ করছেন বাদল নামে এক যুবক। বাংলাদেশে সৌদি আরবের খেজুর চাষ একটি সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। এজন্য কৃষি পর্যায়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
শিহাব খান/এসপি