মানবাধিকার ও পুনর্বাসনবঞ্চিত তারা
তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি থাকলেও তাদের জীবনমানের উয়ন্নন চোখে পড়ার মতো নয়। মানবাধিকারের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের বিষয়ে। পরিবার, সমাজ ও সামাজিকতা― সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন। যেন মানুষ হিসেবে জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী। যদিও সরকারসহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হিজড়াদের বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে।
মানুষ হিসেবে তাদের নেই কোনো সামাজিক মর্যাদা। বরং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বরাবরই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে শোচনীয় জীবনাচরণে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হচ্ছে হিজড়া সম্প্রদায়। সামাজিক অসম দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের অবস্থা এখন দলিতদের (অস্পৃশ্য) থেকেও নগণ্য। এমনটাই অভিযোগ রংপুরে বসবাসরত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর।
রংপুর নগরের নূরপুর জেএনসি রোডে (ছড়ারপাড়) একটি জরাজীর্ণ বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন ৫০ জন। সেখানে তিনটা রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। শীতের সময়ে থাকতে কষ্ট না হলেও গরমকালে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাদের জীবনব্যবস্থা অত্যন্ত নড়বড়ে। অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী নিজেদের অধিকার আদায়ে ‘ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।
সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের বাবু নামে একজনের সঙ্গে কথা হলে আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা তো মানুষ না, হিজড়া। পরিবারের বোঝা, সমাজের বোঝা। আমরা সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। মেথড়-মুচিদেরও (দলিত) থাকার জায়গা আছে। কিন্তু আমাদের জায়গা হয় না। পরিবারের সঙ্গে সবাই থাকতে পারে কিন্তু আমাদের ঠাঁই হয় না। বাড়িওয়ালারা সহজে হিজড়াদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। ভাড়ার অনুপযুক্ত জায়গায়, নয়তো নোংরা পরিবেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। যেন হিজড়া হয়ে জন্মই আমাদের পাপ।
‘আর দশটা শিশুর মতো ছোটবেলায় মা-বাবার আদর জুটলেও যখনই শারীরিক পরিবর্তন খেয়ালে আসে, তখন থেকেই শুরু হয় তিরস্কার, গঞ্জনা আর শাস্তি। যেই মায়ের গর্ভে ঠাঁই হয়েছিল, সেই মাও পরিবার থেকে আলাদা থাকতে বলেন। সময়ের সঙ্গে আচরণগত বৈসাদৃশ্য যেন কেউই মেনে নিতে চান না। পরিবারের সম্মান-মর্যাদা
বাঁচাতে অজানা গন্তব্যে নিজ বাড়ি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। এখনো সময়-সুযোগ হলে মায়ের কাছে ছুটে যাই, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারি না সমাজের ভয়ে।
অশ্রুসিক্ত নয়নে এই কথাগুলো বলছিলেন নতুন নামে আরেক সদস্য। নতুনের মতো প্রায় প্রতিজন হিজড়ার গল্পটা একই। সমাজের বাঁকা চাহনি আর লাঞ্ছনার শিকার হয়ে একসময় বাধ্য হন পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করতে।
সামাজিক অস্বস্তিজনক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে বদরগঞ্জের স্বপ্না বলেন, আমাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা অত্যন্ত নেতিবাচক। অথচ জন্মের পেছনে আমাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু পরিবার-সমাজ আমাদের ঘরছাড়া করেছে। উপায় না পেয়েই আমরা বাঁচার তাগিদে দলবদ্ধ হয়ে থাকছি। কোথাও কোনো কর্ম না পেয়ে পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, স্টেশন বা পার্কে মেয়েলি সাজে দল বেঁধে চলাফেরা করি। স্বাভাবিক ভিক্ষুকের মতো আমরা হাত পেতে চেয়েও ভিক্ষা পাই না। বাধ্য হয়েই সাধারণত অযাচিতভাবে শরীরে হাত দেওয়া, জোরপূর্বক টাকা আদায়, অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে হয়। অনেকেই ভয়ে বা ঝামেলা এড়াতে টাকা দেন। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, টাকা উত্তোলনের সময় আমরাও অত্যাচারের শিকার হয়ে থাকি। তখন কেউ আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসে না। সমাজের কোনো বিবেকবান মানুষও পাশে এসে দাঁড়ায় না। উল্টো হিজড়াদের কটাক্ষ করে।
রংপুর নগরে থাকা হিজড়া জনগোষ্ঠীর দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা বলেন, সামাজিকভাবে হিজড়াদের কোনো প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তেমনি সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানেও ডাকা হয় না। হিজড়াদের সঙ্গে পরিবারের মা-বাবারাও কোনো সামাজিক সম্পর্ক পর্যন্ত রাখে না। কেউ পড়ালেখা করতে চাইলেও বাধা রয়েছে। স্কুল-কলেজের সহপাঠীরা হিজড়াদের সহজেই মেনে নেয় না। বরং বিভিন্নভাবে হেয় করে। হিজড়াদের জন্য আলাদা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই। আমাদের সামাজিক অবস্থা দলিতদের (অস্পৃশ্য) থেকেও নগণ্য। মেথড়-মুচিরা তো পরিবার ও সমাজের সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে অনেকটা একঘরে হয়ে আছি। জীবন-জীবিকার তাগিদে এখন নিজেরাই একত্র হয়ে বাঁচার সংগ্রাম করছি।
কর্মসংস্থান, বাসস্থান, পুনর্বাসনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হিজড়াদের অধিকাংশরই পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। তবে সরকারি-কিংবা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব বলে মনে করছেন এই জনগোষ্ঠীর দলনেতা রানা। তিনি বলেন, মানুষ শুধু আমাদের ওপরটা দেখে। কিন্তু ভেতরের কষ্ট-যন্ত্রণাটা কেউ অনুভব করতে চায় না। আমাদের একেকজনের জীবন যে কত দুঃখ-কষ্টে গড়া, কী ভীষণ কষ্টের পাথর বুকে চেপে আমাদের প্রতিটি দিন পার হচ্ছে, তা আমরা ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের ভিক্ষাবৃত্তি বা বিভিন্নভাবে টাকা আদায়সহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডের আড়ালে এই বিশাল বেদনার ইতিহাসটি চাপা পড়ে যায়। আমরা যে কাজটি করছি, সেটি বেঁচে থাকার সংগ্রামেরই অংশ।
অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতোধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের ‘হিজড়া’ নামেই সম্বোধন করা হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। যদিও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে এই সংখ্যা ২০ থেকে ৫০ হাজার।
কারও কারও মতে, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তবে রংপুরে সমাজসেবা কার্যালয়ের সূত্র বলছে, এ জেলায় প্রায় চার শতাধিক হিজড়া রয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই শহর ও উপশহরে ভাড়া বাসা নিয়ে ছোট ছোট দলভুক্ত হয়ে বসবাস করছেন।
রংপুরে এই জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ নৈতিক মূল্যবোধ ও সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। এ ব্যাপারে লাইট হাউসের নির্বাহী পরিচালক হারুন অর রশীদ বলেন, সবার আগে হিজড়াদের সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ব্যাপারে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বেশি প্রয়োজন। হিজড়াদের বড় সংকট পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা। তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেক সচ্ছল পরিবার থেকে আসা হিজড়াও নিজেদের পরিচয় প্রকাশে লজ্জা বোধ করেন। বেঁচে থাকার জন্য তাদের বেশির ভাগই পেশা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তি বা টাকা আদায়ের পেশার মতো অস্বস্তিজনক নির্মম বাস্তবতায় জড়িয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, আপৎকালীন কোনো ব্যবস্থা বা সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি এমন আইন প্রণয়ণ, যাতে কোনো পরিবারে হিজড়া সন্তানের জন্ম হলে ওই পরিবার তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে না পারে। পরিবারের অন্য স্বাভাবিক সন্তানদের সঙ্গেই হিজড়া শিশুটিরও বেড়া ওঠা থেকে বসবাস নিশ্চিত করতে আইনের প্রয়োজন। এর পাশাপাশি হিজড়াদের এবং তাদের অভিভাবকদের জীবনমান উন্নয়নে মনঃসামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিক শিক্ষার বিষয়ে সচেতন করা দরকার।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ডা. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, হিজড়রা কারও প্রতিপক্ষ নন। তাদের সমাজের স্বার্থেই মূলধারায় নিয়ে আসা উচিত। এতে সামাজিক অবক্ষয় নিরসন সম্ভব হবে। হিজড়ারা যেসব সামাজিক অস্বস্তিমূলক কর্ম করে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ প্রদান করা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাগরিক হিসেবে মানবাধিকার নিশ্চিত করা, জনগণের মধ্যে হিজড়াদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। হিজড়াদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। এই
সম্প্রদায়ের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের দেওয়া সামাজিক সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে হিজড়াদের পুনর্বাসন এবং দক্ষ জনবলে পরিণত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানায় রংপুর সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আব্দুল মতিন বলেন, জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের ৩৭০ জনের তালিকা রয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন বয়স্ক ভাতা আর ১২ জন শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন পড়াশোনা জানা রয়েছেরন। তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এই জনগোষ্ঠীর ১৫০ জনকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের দেড় শ-জনকে তিন ব্যাচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের সেলাই মেশিন, কম্পিউটার, বিউটিশিয়ান, রাঁধুনী, ইলেকট্রিক সার্ভিসিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে তাদের কর্মমুখী হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে অনুদান দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হিজড়াদের মধ্যে যারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, তাদের শিক্ষা উপবৃত্তির আওতার নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনসহ বাসস্থান নিশ্চিত করতে জমি অধিগ্রহণপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নগরের নজিরেরহাট নামক স্থানে দুই একর জমি দেখে তা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অবগত করেছি।
তিনি আরও জানান, সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে কোটা-ভিত্তিক প্রক্রিয়া চালুর বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছেন। পাশাপাশি তাদের জন্য উত্তরাধিকার আইনটি নিয়েও সরকার কাজ করছে। এটি বর্তমানে খসড়া পর্যায়ে রয়েছে।
এ ব্যাপারে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, রংপুরে তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসনব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তাদের আবাসনও প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। তবে রংপুরে বেশির ভাগই হিজড়া রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাস করে। সিটি করপোরেশনের ভেতরে তাদের আবাসনের জন্য জায়গা দেখা হচ্ছে। যদি তারা একসঙ্গে থাকতে চায়, তাহলে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। এ ছাড়া প্রত্যেক ইউএনওকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, যেন তারা উপজেলাগুলোয় খাসজমির ওপর তাদের আবাসন তৈরি করে দেন।
এনএ