মৃত্যুর আগে ফেসবুকে যা লিখে গেছেন গাজী আনিস
জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় নিজের গায়ে আগুন দেওয়া কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ব্যবসায়ী মো. আনিসুর রহমান (গাজী আনিস) মারা গেছেন। মঙ্গলবার (৫ জুলাই) সকাল সোয়া ৬টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এদিকে গত ৩১ মে হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক নুরুল আমিনকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন গাজী আনিস। এটিই ছিল তার শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাস। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
‘প্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষী ভাই বোন বন্ধু। আমি মো. আনিসুর রহমান (গাজী আনিস) একজন কবিতা প্রেমিক মানুষ। নিজে হয়তো ভালো কবিতা লিখতে পারি না, কিন্তু আমি ভীষণভাবে কবিতা ভালোবাসি।
আমি একজন ব্যবসায়ী এবং জীবনে প্রচুর রোজগার করেছি। আমার রোজগারের সবচেয়ে বড় অংশ স্থানীয় স্কুল মাদ্রাসা মসজিদ এবং অসহায় দুস্থ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। সেইসঙ্গে নিজেও সুখী স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং সৎ জীবন যাপন করেছি। আমি তিনটি কন্যা সন্তানের জনক। আমার বড় মেয়ে মেধা রহমান আঁচল এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মেজো মেয়ে প্রতিভা রহমান অহনা এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং ছোট মেয়ে জয়িতা রহমান অবনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
২০১৬ সালে হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার মো. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আমার সখ্যতা এবং আন্তরিকতা গড়ে উঠে। আমি কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং কুষ্টিয়া শহরেই বসবাস করি।
তবে প্রতিমাসেই নিজের প্রয়োজনে ঢাকা এলে তাদের সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হতো এবং উপহার বিনিময় ও ভালো রেস্তোরাঁয় আমরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করতাম এবং বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতাম। যেহেতু আমি স্বচ্ছন্দ দিনযাপনে অভ্যস্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, তাই নিজস্ব গাড়িতেই সব সময় যাতায়াত করি। আমি মো. নুরুল আমিন এবং ফাতেমা আমিনের সঙ্গে নিজের খরচে দেশের বাইরেও একাধিকবার বেড়াতে গিয়েছি।
২০১৮ সালে কলকাতার হোটেল বালাজীতে একইসঙ্গে অবস্থানকালে উনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীতে তাদের পীড়াপীড়িতে আরও ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসেবে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে নেওয়া)। বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু উনারা গড়িমসি করতে থাকেন। একপর্যায়ে উনারা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন সেটাও বন্ধ করে দেন এবং কয়েকবার উনাদের লোকজন দ্বারা আমাকে হেনস্তা করেন এবং ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন। বর্তমানে লভ্যাংশসহ আমার ন্যায্য পাওনা তিন কোটি টাকার অধিক।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া আমলি আদালতে আমি উনাদের আসামি করে দুটি মামলা করেছি যা বিচারাধীন রয়েছে। গত ২৯/০৫/২০২২ তারিখ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করি এবং যাবতীয় ডকুমেন্টস সম্মানিত সাংবাদিকদের নিকট উপস্থাপন করি।
ভীষণ মানসিক নিপট খরায় আমি উল্লেখিত তথ্যাদি উপস্থাপন করলাম। আমার সামনে বিকল্প পথ না থাকায় ফেসবুকেও সবাইকে জানালাম। আমি এই প্রতারক দম্পতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট অনুরোধ করছি। সেইসঙ্গে যারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তারাও সোচ্চার হবেন বলে আশা করছি।’
প্রসঙ্গত, গাজী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তিনি একসময় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের পান্টি বাজার এলাকার মৃত ইব্রাহিম বিশ্বাসের ছেলে।
আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দুপুরে শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোলাম হোসেন খান জানান, গাজী আনিসের ভাই নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
গত ৩১ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে হেনোলাক্স কোম্পানির কাছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা পাওয়ার দাবি করেছিলেন গাজী আনিস। তার এক বন্ধু বলেন, ওই টাকা না পেয়েই সোমবার (৪ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গাজী আনিস।
রাজু আহমেদ/আরএআর