‘বাড়ির কারোর মুখে তেমন খুশির ছিটেফোঁটাও দেখতে পাইনি’
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এবার সেই বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তারই ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) রাতে বুয়েটের ২০২১-২২ ব্যাচের স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। সেখানে ৪৫০তম হয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন নিহত আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ।
বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর শুক্রবার (১ জুলাই) বিকেল ৩টা ৫০মিনিটে আবরার ফাইয়াজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার ওই স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর ইচ্ছায় বুয়েটে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির সুযোগ লাভ করতে পেরেছি। আসলে এখন আমাদের অনেক খুশি হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বাড়ির কারোর মুখে তেমন খুশির ছিটেফোঁটাও দেখতে পাইনি। গতকাল যে সময় আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে ২০১৭ তেও ঠিক ওই একই সময়ে ভাইয়ার রেজাল্ট দিয়েছিল। তখন আমরা ৪ জনই একই ঘরে বসে ছিলাম। সাথে চাচাও ছিল। ভাইয়ার এক বন্ধু ফোন দিয়ে ভাইয়াকে বলেছিল যে বুয়েটের রেজাল্ট দিয়েছে। সেদিনের মতো খুশি ভাইয়াকে আর কখনো দেখিনি। ঠিক যেন চোখ মুখ দিয়ে আনন্দ দেখা যাচ্ছিল। আমিও সেদিন অনেক অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। সত্যি বলতে সেদিনের আনন্দের ১০ ভাগও গতকাল নিজের রেজাল্ট দেখে পাইনি।
এখন পর্যন্ত আমার পরিবারের একজনও বলেনি বুয়েটে ভর্তি হতে। আসলে কারোর সেটা বলার মতো সাহস নেই। আমার দাদা, ভাইয়ার রেজাল্ট শুনে পুরো এলাকায় বলে বেরিয়েছিল, সে কিনা আমাকে বারবার বলছে, “তুই আর বুয়েটে যাস না। দরকার হলে রাজশাহী/খুলনা ভার্সিটিতে পড়। ওরা খুব খারাপ।” কোথায় পড়বো জানি না এখনো। IUT-তে ৪১তম হয়েছিলাম CSE-তে ভর্তি আছি ওখানে।
আমাদের দুই ভাইয়ের বয়স আর ক্লাস গ্যাপ ৪ বছরের। তাই ভাইয়াকে ভর্তির দিনই বলছিলাম, “তাহলে ব্যাপারটা এমন যে তুই বের হবি আর আমাদের ব্যাচ ঢুকবে ”। ভাইয়া একবার আম্মুকে বলেছিলো, “এখানে দেখি যার বড় ভাইও পড়ে ছোট ভাইরাও বুয়েটেই আসে। তোমার ছেলে কী করবে?”
ভাইয়ার আসলে অনেক আশা ছিলো যে আমিও ভালো কোথাও ভর্তি হবো। ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে বলছিলো, “তুমি তো সাব্বির? তুমি নাকি অনেক ভালো ছাত্র। তুমি কী বুয়েটে আসবা? তোমার ভাই তো বলে তোমারো নাকি বুয়েটে ইচ্ছা?” আমি জানি না ভাইয়া সবসময় কেন আমাকে পড়ালেখায় ভালো ভাবতো যেখানে আমি ভাইয়া বেঁচে থাকতে তেমন কোনো ভালো রেজাল্টই করিনি শুধুমাত্র স্কুলের পরীক্ষা বাদে। আসলে আমার থেকে ওরই আমার ওপর বেশি ভরসা ছিল।
ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে ভাইয়ার এক স্টুডেন্ট আর তার মা বাসায় এসে বলে, “তোমার ভাই কিন্তু তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। সবসময় বলতো তোমার কথা। তুমি কোথায় পড়বা এসব কথা সবসময় বলতো। ”
ভাইয়ার রেজাল্টের দিন ভাইয়া একটা পোস্ট দিয়েছিলো আলহামদুলিল্লাহ লিখে ফেসবুকে, আমি আবার তখন জোর করে বলেছিলাম, আমাকে ট্যাগ করতে। হয়তো আজ উল্টোটা হতো। প্রথমবারের মতো ভাইয়ার খুশি হওয়ার মতো কিছু হতে পারতো এটা, কিন্তু সেটা আর হলো না।
এরপর কী করব জানি না এখনো। এতদিন তো শুধু ভাইয়ার দেখানো পথেই এগিয়েছি। বলা যায় ভাইয়ার দেখানো পথ এখান পর্যন্তই ছিলো। এরপরের দিনগুলো কেমন হবে সেটা আর আমাকে দেখিয়ে যাওয়ার সুযোগ ভাইয়া পায়নি। জানি না ভাইয়া কী অবস্থায় আছে, কোথায় আছে কিন্তু এখন যতটা মিস করি ততটা আগে কখনো করিনি।
আপনারা সবাই আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এত ভালোবাসার যোগ্য আমরা কিনা জানি না । আসলে আমার শিক্ষক, বন্ধু কিংবা তেমন চিনি না এমন অনেকেও আমাদের যেভাবে গত কয়েক বছর সাপোর্ট দিচ্ছেন এটা আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। সকলের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই।’
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরে বাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় আবরারের বাবা বাদী হয়ে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদকে হত্যার দায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
রাজু আহমেদ/আরএআর