যেভাবে ‘জমিলা কসাই’ হয়ে উঠলেন তিনি
নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পুরুষের সঙ্গে সমান তালে লড়াই করে চলা সফল নারী ব্যবসায়ী দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বাড়ি হাটের জমিলা বেগম ওরফে জমিলা কসাই (৪৯)। নিজেকে কসাই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে জমিলাকে সমাজের নানা বাধা পেরুতে হয়েছে।
অজোপাড়া গায়ে তার জীবনযুদ্ধটা ছিল বেশ কঠিন। মানুষের কটু কথা ও সব বাধাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেকে সফল নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন সম্মাননা ও পুরস্কার।
জমিলা বেগমের মাংস বিক্রির দোকানটির নাম রাখা হয়েছে মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার। এ মাংসের দোকানে মিলবে শতভাগ হালাল মাংস। দোকানটির বিশেষ গুণ হলো এখানে ক্রেতার পছন্দ মতো মাংস দেওয়া হয়। সঠিক পরিমাপে হাড়-চর্বি বাদে মাংস বিক্রি করা হয়।
বিয়ে বাড়ি, খৎনাসহ আশপাশের গ্রাম-শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জমিলার দোকানের মাংস বেশ জনপ্রিয়। দুই দশকের টানা অভিজ্ঞতায় তিনি ক্রেতাদের কাছে হয়ে উঠেছেন বিশ্বস্ত। এলাকায় এখন ‘জমিলা কসাই’ নামেই পরিচিত তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ঝাড়বাড়ী হাটে মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডারে খুব সকাল থেকে শুরু হয়েছে কর্মব্যস্ততা। কেউ দোকান গোছগাছ করছেন আবার কেউ গরু জবাই করে চামড়া আলাদা করছেন। জমিলা খাতুন নিজেও গরুর চামড়া আলাদা করছেন। কিছুক্ষণ পর দোকানে বসে মাংস কাটতে শুরু করলেন জমিলা বেগম।
এদিকে দোকানে মাংস আসার আগেই দোকানের বাইরে ক্রেতাদের ভিড় ছিল চোখে পরার মতো। জমিলা বেগম নিজে মাংস কাটছেন, ডিজিটাল পাল্লায় মাপছেন, আবার টাকা গুনছেন। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কেউ দুই কেজি, কেউ পাঁচ কেজি আবার কেউ ২৫ কেজি পর্যন্ত মাংস কিনছেন। তার হাত যেন আরেক ডিজিটাল পাল্লা। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যা পাল্লায় তুলছেন তা একেবারে সমপরিমাণ হয়ে যাচ্ছে।
প্রতি সপ্তাহের সোমবার বাদে ছয়দিনই মাংস বিক্রি করেন তিনি। তবে শুক্রবার মাংস বিক্রি বেশি হয়। অন্যান্য দিনে মাংস বিক্রি ৭ থেকে ১০ মণ হলেও এই দিনে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ মণ মাংস। গড়ে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪টি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করেন তিনি। শুধু নিজ এলাকার নয়, ক্রেতারা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। বিশেষ করে বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জ, গড়েয়া হাট, কাহারোল, বসুনিয়া, লাহিড়ী, কালমেঘ, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, খানসামা উপজেলা এমনকি ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী শহর থেকেও ক্রেতা আসেন জমিলার দোকানে মাংস কিনতে।
ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া এলাকা থেকে মাংস কিনতে আসা রাজিউল ইমলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমিলার দোকানের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হাড়ছাড়া মাংস বিক্রি করেন। পরিমাণে সঠিক দেন। অন্যান্য দোকানে মাংস দেয় একরকম, বাসায় এসে দেখি মাংসে হাড় আর চর্বি। অনেক সময় ওজনও সঠিক পাওয়া যায় না। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে জমিলা কসাইয়ের দোকান থেকে গরুর মাংস কিনি।
খানসামা উপজেলা শহর থেকে মাংস কিনতে আসা হোটেল ব্যবসায়ী আরিফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার হোটেলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি মাংস বিক্রি করে থাকি। আমি প্রতিদিন ঝাড়বাড়ি হাটের জমিলা কসাইয়ের মাংসের দোকান থেকে মাংস ক্রয় করে করি। তিনি হাড় ও চর্বি ছাড়া ভালো মাংস আমাকে দিয়ে থাকেন। আমি ৭ বছর ধরে জমিলা ভাবির দোকান থেকে মাংস ক্রয় করছি।
জমিলা কসাইয়ের ছেলে জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারিবারিক সমস্যা থাকায় ছোটবেলা থেকে ব্যবসায় মায়ের পাশে দাঁড়ানোর কারণে বেশিদূর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। তবে মাকে নিয়ে অনেক গর্ব হয়। মা বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি সংগঠন থেকে পুরস্কার পায়। ছেলে হিসেবে সেটা আমার জন্য গর্বের। মায়ের কারণে আজ আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হতে পেরেছি। পাশাপাশি ৭ থেকে ৮ জনের কর্মসংস্থানের যায়াগা হয়েছে আমাদের দোকানে।
জমিলা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা জাকির হোসেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকে বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ী হাটে এসে পানের ব্যবসা শুরু করেন। আমরা চার ভাইবোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। স্কুলে যাওয়া হয়নি আমার। ১৪ কিংবা ১৫ বছর বয়সে বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার রফিকুল ইসলাম ভান্ডারীর সঙ্গে বিয়ে হয়। আমার স্বামী পেশায় একজন কসাই ছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় আমাকে বিয়ে করেন। আমার প্রথম সন্তান জহুরুলের জন্মের কিছুদিন পর আমার স্বামী মাদকাসক্ত হয়ে ব্যবসা নষ্ট করে ফেলেন। ২০০০ সালের দিকে আমার স্বামী রফিকুল ইসলামকে নিয়ে বগুড়া থেকে বাবার বাসায় এসে ঝাড়বাড়ী হাটে একটি মাংসের দোকান শুরু করি। সে সময় দোকানে স্বামীকে সময় দিতাম। আস্তে আস্তে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্নজনের কাছ থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা ধারদেনা করে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান আমার স্বামী। তখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটতে থাকে। আমার স্বামীর পাওনাদাররা আমাকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। নিরুপায় হয়ে ছেলে জহুরুলকে সঙ্গে নিয়ে বাজারের মাংসের দোকান চালু করলাম। নাম দিলাম মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার। নিজে হাটে গিয়ে দেখেশুনে গরু বাকিতে কিনতাম। পরদিন মাংস বিক্রি করে গরুর দামের সঙ্গে ৩শ থেকে ৫শ টাকা বেশি দিতাম। এভাবে শুরু করে পরে আস্তে আস্তে মাংস ক্রেতাদের কাছে মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। পরে দিনে দিনে ব্যবসা বাড়তে থাকে।
মা-ছেলে মিলে আস্তে আস্তে শোধ করে দেই স্বামীর দেনা। বাড়ির পাশে ১১ শতক জমি কিনে বাড়ি বানাই। ছোট পরিসরে একটি গরুর খামারও শুরু করেছি। বাড়ির সামনে একটি মুদিখানার দোকান দিয়েছি। মাংস বিক্রি শেষে সেখানেও সময় দেই। সব মিলিয়ে ছেলে জহুরুল, তার স্ত্রী এবং দুই নাতি এবং মেয়ে সোহাগীকে নিয়ে আল্লাহর রহমতে সুখেই আছি।
জমিলা বেগম বলেন, গল্পটা যেমন সহজে সাফল্যে রূপ নিল, বাস্তবতা ততটা সহজ ছিল না। ঝাড়বাড়ি হাটে আরও চার-পাঁচজন মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন। স্বামী চলে যাওয়ার পর যখন দোকান শুরু করি তখন অনেকেই বিরোধিতা করেন। থানায় ও ইউনিয়ন পরিষদে আমার নামে অভিযোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু এলাকার কিছু লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। উৎসাহ ও সাহস দেন।
ইমরান আলী সোহাগ/আরএআর