ধার করা ৩০ হাজার টাকায় মাছ চাষে কোটিপতি
ময়মনসিংহ জেলায় বার্ষিক মাছ উৎপাদন ৩ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। জেলায় বার্ষিক মাছের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। এখানকার চাহিদা পূরণ করে বার্ষিক মাছ উদ্বৃত্ত থাকছে ২ লাখ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ এই পরিমাণ মাছ যাচ্ছে অন্য জেলায়। এ জন্য মাছ উৎপাদনে সফল জেলা হিসেবে প্রথম নাম উচ্চারিত হয় ময়মনসিংহের।
জেলায় বর্তমানে ১ লাখ ৭৬ হাজার পুকুরের বিপরীতে এক লাখ খামারি মাছ চাষে জড়িত রয়েছেন। অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় এ পেশার মাধ্যমে অসংখ্য চাষি তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন, হয়েছেন বিত্তশালী। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অন্যদেরও করছেন স্বাবলম্বী।
ময়মনসিংহে একজন সফল ব্যক্তি এ কে এম নুরুল হক। ১৯৮৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। টিভিতে মাছ চাষবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে মনস্থির করেন, তিনিও শুরু করবেন মাছ চাষ। মহাজনি সুদে ধার করা ৩০ হাজার টাকা আর ভাড়া করা কয়েকটি পুকুর দিয়ে যাত্রা শুরু করা সেই নুরুল হক আজ কোটিপতি। শহরতলি শম্ভুগঞ্জের চরপুলিয়ামারী এলাকায় গড়ে তুলেছেন ব্রহ্মপুত্র ফিশ ফিড কমপ্লেক্স। কিনেছেন ২০ একর জমিও। নগরের জিলা স্কুল মোড় এলাকায় পাঁচতলা বাড়ি ও বিলাসবহুল গাড়ির মালিক এখন তিনি। একাধিকবার পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।
পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় মনোবলই এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে নুরুল হককে। মাছ চাষে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৭ সালে জাতীয় যুব পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পদক (রৌপ্য), ২০০৯ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পদক (স্বর্ণ) ও ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক (ব্রোঞ্চ) পেয়েছেন।
নুরুল হক বলেন, শুরুতে এ কাজে পারিবারের বাধা ছিল। গণিতে অনার্স পাস করে অন্য চাকরি না করায় বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তিন বছর থেকেছি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার বারান্দায়। পরে শুরু করি মাছ চাষ। অনেক কষ্টের পর সফলতা আসতে শুরু করল। তখন অবশ্য সবাই মেনে নিয়েছিলেন এবং উৎসাহ জুগিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, প্রথম দিকে পুকুরে রেণু থেকে পোনা উৎপাদনের কাজে হাত দিলেও চাহিদা বাড়ায় ১৯৯৩ সালে ব্রহ্মপুত্র ফিশ ফিড কমপ্লেক্স নামে একটি হ্যাচারি গড়ে তোলেন। এখানে কার্প জাতীয় রেণু উৎপাদন করা হতো। ১৯৯৮ সালে দেশি মাগুর ও ১৯৯৯ সালে শিং মাছের পোনা উৎপাদন শুরু করেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত চলে এটি। এরপর ২০০১ সালে পাবদা, ২০০৩ সালে থাই কই মাছের পোনা উৎপাদনে সফল হন। ২০১০ সাল থেকে তেলাপিয়ার সুপার পুরুষ থেকে শুধু পুরুষ পোনা উৎপাদন, ২০১৫ সালে গাং মাগুর ও ২০১৮ সালে মলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন শুরু করেন। সর্বশেষ ২০২০ সাল থেকে রানি মাছ নিয়ে কাজ করছেন নুরুল হক।
মাছ চাষে দিনবদলের এমন গল্প এ জেলায় নেহাত কম নয়। ১৯৯৭ সালে ত্রিশাল উপজেলার একটি প্রকল্প দেখে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন জয়নাল আবেদিন। উপজেলার কোনাবাড়ি এলাকায় ধানি জমিতে চারটি ও ভাড়ায় দুটি পুকুর দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর লাভের টাকা দিয়ে বাড়াতে থাকেন পুকুরের সংখ্যা। বর্তমানে ৬০ একর জমির ওপর তার প্রায় চার কোটি টাকার মাছের খামার। কয়েক লাখ পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই, কাতল, সিলভার, মৃগেল মাছ রয়েছে খামারটিতে। খামারে দিন-রাত কাজ করেন প্রায় ২০ জন শ্রমিক। সেই সঙ্গে তার অর্থায়নে ৪০০ শিক্ষার্থীর একটি কওমি মাদ্রাসা পরিচালনার মাধ্যমে তিনি সামাজিকভাবেও অবদান রাখছেন।
মাছ চাষে লাভবান হওয়া কয়েকজনকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে দেড় যুগ আগে এ পেশায় আসেন ত্রিশালের ছলিমপুর গ্রামের খাইরুল বাশার মাহবুব। পরিবারের বাধা এলেও একক সিদ্ধান্তে নিজস্ব জমির ওপর দুটি পুকুরে দেশি মাছ চাষ শুরু করেন খাইরুল। এরপর প্রতিবছর প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। বর্তমানে ১৭ একর জমিতে ১৬ পুকুরে পাবদা, গুলসা, শিং, টেংরা, কই, পাঙাশসহ দেশি প্রজাতির মাছ চাষ করছেন। লাভের টাকা দিয়ে তিনি একটি হ্যাচারি ও একটি পোলট্রি ফার্মও করেছেন। তাকে দেখে এলাকার প্রায় অর্ধশত যুবক মাছ চাষে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।
খাইরুল জানান, অন্যান্য চাষিদের ভালো ও গুণগত মানের মাছের পোনা তুলে দিতে তিনি একটি হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই হ্যাচারি থেকে উৎপাদিত পোনা থেকে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি এলাকার মাছচাষিদেরও লাভবান করতে পেরেছেন।
একসময় ধানের ব্যবসা করতেন মুক্তাগাছা উপজেলার বাঁশাটি গ্রামের আহম্মদ আলী। কিন্তু বারবার লোকসানের মুখে পড়েন তিনি। পরে এ ব্যবসা ছেড়ে মাছ চাষে আগ্রহী হন তিনি। ২০০০ সালে সাড়ে ৬ শতাংশ জমিতে একটি পুকুরে ১ হাজার ২০০ পাঙাশ দিয়ে শুরু হয় তার যাত্রা। তবে বছর শেষে লাভের মুখ দেখতে পারেননি তিনি। বেশ কিছু মাছ মারা যাওয়ার কারণে সে বছর লোকসান গুনতে হয় ৫ হাজার টাকা। তারপরও হাল ছাড়েননি আহাম্মদ।
আরও একটি পুকুর ভাড়া নিয়ে পরের বার তিন হাজার পাঙাশ চাষ করেন তিনি। এতে ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। সে বছর লাভ হয় ৯০ হাজার টাকা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বছরে কোটি টাকাও আয় করেছেন তিনি। ২০০৮ সালে শুরু করেন হ্যাচারি ব্যবসা। পান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। বর্তমানে তার পুকুরের সংখ্যা ৬০। পাঙাশ, মনোসেক্স তেলাপিয়া, গুলসা, টেংড়া, শিং, শোলসহ বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছ চাষ করছেন এগুলোয়। তার হ্যাচারি থেকে উৎপাদিত পোনা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষ হচ্ছে।
মাছ চাষে সফল বাবা আহাম্মদ আলীকে অনুসরণ করেই ছেলে আব্দুল হালিম তরুণ বয়সেই নাম লেখান এ পেশায়। বাবার গড়ে তোলা হ্যাচারিতে শুরু করেন পোনা উৎপাদন। ২০১১ সালে ঢাকায় ক্যাটালিস্টের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন হালিম। ২০১৪ সালে ক্যাটালিস্টের মাধ্যমে হালিম ফিলিপাইনে যান একটি প্রশিক্ষণে। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের হ্যাচারিতে মনোসেক্স ও ফিলিপাইন থেকে নিয়ে আসা উন্নত জাতের রেণু থেকে পোনা উৎপাদন। যা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ২০১৬ সালে গুণগত মাছের পোনা উৎপাদনের স্বীকৃতিও পেয়ে যান ৩০ বছরের এ যুবক। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পান স্বর্ণপদক।
সফল এসব মাছচাষি যেমন নিজেরা সমৃদ্ধ হচ্ছেন, তেমনি অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করছেন। সৃষ্টি করছেন কর্মসংস্থানও। রাখছেন অবদান দেশের অর্থনীতিতে। মাছের পুকুর ও হ্যাচারিতে কাজ করা শ্রমিকরা জানান, কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন তারা। যা দিয়ে চলে তাদের সংসার।
ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে যতগুলো জেলায় মাছ চাষ হয়, তার মধ্যে ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় এবং বিভিন্ন জেলায় আমরা পাঠাই। জেলায় যারা মাছ চাষ করছেন এবং যারা নতুন আগ্রহী, তাদের জেলা মৎস্য অফিস থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ অর্থবছরে ইতোমধ্যে আমরা তিন হাজার চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আরও দেড় হাজার চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে আমাদের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তারা যাতে বড় ঋণ নিতে পারেন, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
এনএ