বুধবার চালু হচ্ছে তৃতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আগামীকাল ১ জুন থেকে বাংলাদেশের চিলাহাটি ও ভারতের হলদিবাড়ি রুটে চালু হচ্ছে আন্তঃদেশীয় তৃতীয় যাত্রীবাহী ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত চলাচল করবে এই ট্রেন। এ উপলক্ষে দুই দেশের রেল বিভাগ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী অ্যাড. নূরুল ইসলাম সুজন ও ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বীনি বৈষ্ণব ভার্চুয়ালি এর উদ্বোধন করবেন।
তবে দীর্ঘ ৫৭ বছর পর এ পথে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও নীলফামারীর চিলাহাটি সীমান্ত স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা বা টিকিট করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েছে এ এলাকার মানুষের।
জানা গেছে, এর আগে দার্জিলিং মেইল নামে একটি ট্রেন চলাচল করত এ রুটে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ট্রেনটির চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কয়েক বার এ রুটে ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
৫৫ বছর পর ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর এই রেলপথ আবার চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৭ মার্চ প্রতীকী যাত্রীবাহী ট্রেন ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ চলাচলের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর থেকে মালবাহী ট্রেন চলাচল করলেও করোনাভাইরাস ও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে যায় যাত্রীবাহী ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেসের যাত্রা।
অবশেষে বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে এই ট্রেনের ঐতিহাসিক পুনঃযাত্রা।
বুধবার (১ জুন) দুপুর ১২.১০ মিনিটে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছাড়বে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেন। চিলাহাটিতে এসে ট্রেনটি ৩০ মিনিট যাত্রা বিরতির পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছাবে রাত সাড়ে ১০টায়। পরদিন ঢাকা সেনানিবাস স্টেশন থেকে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যাবে ভারতের নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছাবে সকাল ৭টা ৫ মিনিটে।
চিলাহাটিতে ইমিগ্রেশন চান স্থানীয়রা
উত্তরের জেলা নীলফামারীর মানুষ এই রুটে ট্রেন চালুর খবরে বেশ উচ্ছ্বসিত। তবে তারা কিছুটা আশাহতও। কারণ, এখন এই ট্রেনের কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না তারা। চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদি বাড়ির দূরত্ব মাত্র ৬৯ কিলোমিটার হলেও সেখানে চালু হয়নি ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা। এতে নীলফামারীবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলেও, পূরণ হয়নি প্রত্যাশা। দ্রুত ইমিগ্রেশন জটিলতা দূর করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের সুবিধার্থে চিলাহাটি স্টেশন থেকে যাত্রী ওঠানামার ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
চিলাহাটি স্টেশন এলাকার বাসিন্দা কামরুল বসুনীয়া হতাশার কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই ট্রেন চালু করি কি হামার হইল। এই ট্রেনত করি ভারত যাবার গেলে হামাক ঢাকাত যাবার লাগবে। হামার চিলাহাটিত ট্রেন থামবে। শুধু দেখিমো, হামরা চরির পামো না। এই স্টেশনত ঢাকাত ঝামেলা করি যায়া তারপর ট্রেন চড়ি ভারত যাওয়া হামাক দিয়া হবার নয়, তাতে টাকাও মেলা খরচ হবে। হামরা চিলাহাটি স্টেশনত মিতালী ট্রেনত উঠি ভারত যাবার চাই, সেই ব্যবস্তা যেন সরকার হামার করে।’
আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি জানান, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি চিলাহাটিতে ট্রেনটি থামানো এবং সেখান থেকে এই অঞ্চলের মানুষ যাতে সহজেই ভারত যেতে পারে। চিলাহাটি থেকে যাত্রী ওঠানামা করা হলে এই এলাকার মানুষকে আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না।
স্থানীয় রতন রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিতালী ট্রেন চলাচল শুরু আমাদের জন্য সুখবর হলেও বর্তমানে আমাদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। কারণ আমরা চিলাহাটি থেকে ট্রেনে চড়ে ভারত যেতে পারব না। ভারত যেতে হলে আমাদের ৫০০ কিলোমিটার দূরে ঢাকায় গিয়ে ট্রেনে উঠতে হবে।
ডোমার শহরের আব্দুল্লাহ ইবনে খালিদ বলেন, ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় আমরা খুশি। আপাতত চিলাহাটি থেকে ট্রেনে যাত্রী ওঠা সম্ভব না হলেও এক সময় অবশ্যই চিলাহাটি থেকেও যাত্রা করা যাবে বলে আশা রাখি।
জামান নামে এক ব্যবসায়ী জানান, ট্রেন চালু হওয়ায় এই এলাকার মানুষের দাবি পূরণ হয়েছে। তবে চিলাহাটি থেকে যাত্রী ওঠানামা করানো গেলে বিষয়টি আরো সুন্দর হতো।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসিম কুমার তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পহেলা জুন থেকে মিতালী এক্সপ্রেস চলাচল শুরু করবে। এদিন ৪০৯ জন যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে নীলফামারীর চিলাহাটি হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছাবে। মিতালীতে রংপুর বিভাগের পাসপোর্টধারী যাত্রীদের জন্য দুটি কোচ বরাদ্দ রয়েছে। এই ট্রেনে ভ্রমণকারী যাত্রীদের অবশ্যই করোনা টিকা গ্রহণের সনদ থাকতে হবে ।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পহেলা জুন চিলাহাটি দিয়ে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকায় প্রবেশ করবে। করোনাভাইরাসের কারণে ট্রেনটি চলাচল বন্ধ ছিল। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস জটিলতা থাকার কারণে চিলাহাটি স্থলবন্দরে ভিসা এবং টিকিটের কার্যক্রম করা যাচ্ছে না। আপাতত ঢাকা থেকে ভিসা এবং টিকিটের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে। আমরা রেল মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, যাতে উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য ভিসা এবং টিকিট চিলাহাটি স্থলবন্দরে ব্যবস্থা করা হয়। আশা করছি অতি দ্রুত এর সুফল পাব।
মিতালি এক্সপ্রেস চলবে সপ্তাহে ৪ দিন
সূত্র মতে, মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পর্যন্ত সপ্তাহে চারদিন চলাচল করবে। ট্রেনটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে এনজিপি’র উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। আর প্রতি সপ্তাহের রোববার ও বুধবার ভারতের এনজিপি থেকে ভারতীয় সময় বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করেছে দুই দেশের রেল বিভাগ। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনে ভ্রমণকরসহ প্রতিটি এসিবাথ সিটের ভাড়া ৫ হাজার ২৫৫ টাকা, এসি সিট ৩ হাজার ৪২০ টাকা, এসি চেয়ার ২ হাজার ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ট্রেনটি দিনের বেলায় ৪৫৬ আসন এবং রাতে ৪০৮ আসন নিয়ে চলাচল করবে।
ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি (শিলিগুড়ি) থেকে ঢাকার মোট দূরত্ব ৫৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতীয় অংশে ৮৪ ও বাংলাদেশ অংশে ৪৪৬ কিলোমিটার। তবে কোনো স্টেশনে ট্রেনটি যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য থামবে না। যারা এ ট্রেনের যাত্রী হবেন তারা ঢাকায় উঠে নামবেন নিউ জলপাইগুড়ি। আবার যেসব যাত্রী নিউ জলপাইগুড়ি থেকে এই ট্রেনে উঠবেন তারা নামতে পারবেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে।
এই ট্রেনে থাকছে ১০টি তাপানুকূল কোচ। এর মধ্যে চারটি করে আটটি এসি ফার্স্টক্লাস ও এসি চেয়ার কোচ। বাকি দুটি জেনারেটর ও ব্রেকআপ ভ্যান থাকবে। পাঁচ বছর পর্যন্ত অপ্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য মূল ভাড়ার ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং পাঁচ বছরের কমবয়সী যাত্রীর ক্ষেত্রে ২০ কেজি ওজনের মালামাল বহন করতে পারবেন। ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে বাংলাদেশ অংশে ঢাকা, কমলাপুর, চট্টগ্রাম ও নীলফামারীর চিলাহাটি স্টেশন এবং ভারতের অংশে কলকাতার ফেয়ারলী প্যালেস ও নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।
এমএএস/জেএস