হঠাৎ মারা যাচ্ছে লিচুগাছ, ভাঙছে কৃষকের স্বপ্ন
সারি সারি গাছ। গাছে পাকা লিচু। কয়েকদিনের মধ্যেই সেগুলো বাজারে বিক্রি করা হবে। পরিচর্যার জন্য কুঁড়েঘর বানিয়ে বাগানেই অবস্থান করছিলেন মালিকরা। কিন্তু হঠাৎ চোখের সামনে ঘণ্টার ব্যবধানে গাছগুলো শুকিয়ে মারা যেতে দেখল চাষিরা। এমনই ঘটনা ঘটেছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার খয়েরতলা গ্রামে। কিন্তু গাছগুলো কেন মরছে তার সঠিক কারণ জানেন না বাগানমালিকরা।
তাদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর বৃষ্টির পানি বেশি জমে থাকলেও গাছের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাহলে এখন কোন কারণে গাছগুলো মারা গেল?
সরেজমিনে লিচু বাগানে দেখা যায়, গাছে হাজার হাজার লিচু শুকিয়ে ঝুলে আছে। মরা গাছের ডাল কেটে তাতে গোবর দিয়ে রাখা হচ্ছে। গাছগুলো বাঁচবে সেই আশায়। গ্রামের ২০ একর জমিতে ২০ জন চাষি লিচু চাষ করেছেন। প্রতি একরে ৬০-৬৫টি করে লিচুগাছ লাগানো হয়েছে।
কৃষি বিভাগ ও কৃষকদের দেওয়া তথ্য মতে, বিরল ও রহস্যজনক কারণে মারা গেছে ৮ জন কৃষকের ১৭০টিরও বেশি লিচুগাছ।
উপজেলার খয়েরতলা গ্রামের লিচুচাষি তানভীর। তার একটি লিচু গাছের পাতা নুইয়ে পড়ে। ২ ঘণ্টার ব্যবধানে তার বাগানের ৯৬টি গাছের মধ্যে ৬৬টি গাছ মারা যায়। শুধু তার বাগানই নয়, একই গ্রামের আবুল হোসেনের ১৫টি, তাজউদ্দিনের ১১টি, আনছার আলীর ৫টি, লিটনের ৩টি, জাহিদুল ইসলামের ২০টি, শহিদুল ইসলামের ১৫টি ও আব্দুল জব্বারের ৩৫টি লিচুগাছ পর পর মারা গেছে। ফল দেওয়া গাছ মারা যাওয়ায় তাদের প্রায় ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তানভীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় একর জমিতে ৯৬টি লিচু গাছের মধ্যে ৬৬টি গাছই মারা গেছে। গত ১৪ মে বেলা ১১টা পর্যন্ত গাছগুলো তরতাজা ও সতেজ ছিল। কিন্তু দুপুর ১২টার পর পরই গাছের পাতা নুইয়ে পড়ে। লিচু লাল রং থেকে পুড়ে যাওয়া রং ধারণ করে। চোখের সামনেই গাছের পাতাসহ লিচু শুকিয়ে যেতে থাকে। এই লিচুকে ঘিরেই তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ২৬ বছর ধরে পরিবারের খরচ মিটিয়ে চার ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চলত লিচু বিক্রির টাকা দিয়ে। এখন সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি বয়স্ক গাছ থেকে মৌসুমে ২০-৩০ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করা হয়। এ বছর বাগান থেকে ৮ লাখ টাকার লিচু বিক্রির আশা ছিল। কোনো এক অজানা কারণে গাছগুলো এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেল।
কৃষক বাবুল আক্তার ঢাকা পোস্টকে জানান, তাদের দুটি বাগানে ১৫২টি লিচুগাছ আছে। বাবাকে বাগানে রেখে দুপুরে বাড়িতে খেতে গিয়েছিলেন। তখন বাবা ফোন করে বলে দ্রুত বাগানে আসতে। দ্রুত বাগানে এসে দেখি গাছগুলো মারা যাচ্ছে। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার মধ্যে বাগানের ১৫টি গাছ মারা গেছে। এই ক্ষতি কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। একজন মানুষ স্ট্রোক করলেও একটু সময় দেই, সেই সময়টুকুও আমরা লিচুগাছের ক্ষেত্রে পাইনি।
তিনি আরও বলেন, কৃষি অফিসার আমাদের বাগানে এসেছিল। তারা জানিয়েছেন, বাগানে পানি ওঠার কারণে গাছগুলো এভাবে মারা গেছে। কিন্তু এর আগে অনেক বৃষ্টি হয়েছে, তখন মরেনি। আবার আমাদের বাগানে কখনো পানি বেঁধে থাকত না। তাহলে কীভাবে পানির কারণে মারা যেতে পারে?
বেজপাড়া গ্রামের কৃষক শাহাজান আলী জানান, বাগানের মাঝখান থেকে হঠাৎ করে চারটি গাছ মারা গেছে। কী কারণে মারা গেছে তা কেউ বলতে পারছে না। বাগানের একটি গাছ থেকে ২০ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেছেন। সেখানে চারটি গাছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে তার।
লিচু ব্যবসায়ী উত্তম সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ বছর তিনটা লিচু বাগান কিনেছি। লিচুগুলো যখন লাল রং ধারণ করছিল ঠিক তখন বাগান কিনেছিলাম। সে সময় কৃষকের কাছ থেকে ২৪-২৫ হাজার টাকা করে ক্রয় করেছিলাম। এখন হঠাৎ করে বাগানের চারটি গাছ মারা গেছে। এতে আমাদেরও ক্ষতি আবার কৃষকেরও ক্ষতি। এছাড়া হঠাৎ হঠাৎ ঝড়ের কারণে লিচুর ফলন কমে গেছে।
কৃষক আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩৬ বছর ধরে গ্রামে লিচুচাষ করছি। একটি গাছে ৩-৪ বছর পর ফল আসে। একটি পরিপূর্ণ বাগান থেকে প্রতি বছর ১৫-১৬ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করি। হঠাৎ অজ্ঞাত কারণে গাছগুলো মারা যাওয়াতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি অফিসার এসে দেখে যদি নির্দিষ্ট করে বলে আপনাদের বাগানের গাছগুলো এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, তাহলে আমরা সেই অনুযায়ী গাছগুলো পরিচর্যা করতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা নির্দিষ্ট করে কোনো রোগের কথা বলতে পারেনি। এখন মনের বুঝ দেওয়ার জন্য গাছের ডাল কেটে গোবর দেওয়া হচ্ছে। যদি কোনোভাবে গাছগুলো বেঁচে ওঠে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মোহায়মেন আকতার বলেন, বৃষ্টির কারণে বাগানে পানি জমে থাকে। সেখান থেকে পানি বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যার ফলে বৃষ্টির পানি গাছের শিকড়ে গিয়ে গাছগুলো মারা গেছে। তবে বাগানে যদি পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়ত গাছগুলো এভাবে মারা যেত না। তবে কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনোভাবেই দুই এক বছরের মধ্যে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
এসপি