দৃষ্টিহীন পরিবারের একমাত্র ভরসা সাফিয়া
বিয়ের কয়েক বছরের ব্যবধানে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্বামী দৃষ্টিশক্তি হারান। এর কিছুদিন পর ছেলেও চোখের দৃষ্টি হারায়। স্বামী-সন্তান দৃষ্টি হারানোর পর সংসারের সব দায়িত্ব তাকেই কাঁধে নিতে হয়। এরপর থেকে তিনি শিঙাড়া, চপসহ মুখরোচক খাবার তৈরি করে বাজারে বিক্রি শুরু করেন। এ আয় দিয়ে কোনো রকমে চলে তাদের জীবন।
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার পৌরসভার সাতগাছি গ্রামে বাড়ি সাফিয়া খাতুনের। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বাড়িতে চপ-শিঙাড়া তৈরি করে তিনি জীবনসংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
তার এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য একমাত্র ভরসা দৃষ্টিহীন স্বামী ও সন্তান। বাজারের একটি টং-দোকানে বসে এসব বিক্রি করেন তারা। তবে স্বামী শমসের স্ট্রোক করে অসুস্থ হন কিছুদিন আগে। এখন এসব পণ্য বিক্রি করছেন দৃষ্টিহীন ছেলে উজ্জল। এভাবেই উপার্জন করে পরিবারের পাঁচ সদস্যের জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, মা সাফিয়া খাতুন নিজ হাতে, চপ, শিঙাড়া, ছোলা রান্না করছেন। রান্নার পর সেগুলোকে বাজারের টং-দোকানে দিয়ে আসেন। মায়ের হাত ধরে ছেলে উজ্জল দোকানে পৌঁছে সেগুলো বিক্রি করছেন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, তাদের তৈরি খাবারগুলো খুব সুস্বাদু হয়, দামেও কম। সাধারণত বাজারে যে শিঙাড়া বিক্রি হয় ৫ টাকা, তাদের দোকানে দুটির দামই ৫ টাকা। এ ছাড়া শহরের খাবারগুলো রাস্তার পাশে থাকায় ধুলাবালুতে ভরা থাকে। অথচ তাদের তৈরি খাবার ধুলাবালু ছাড়া ও স্বাস্থ্যসম্মত।
কথা হয় দৃষ্টিহীন ছেলে উজ্জলের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পরিবারে পাঁচজন সদস্য আছে। তার মধ্যে বাবা ও আমি সংসারের আয়-রোজগার করতাম। এখন আমরা দুজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। মায়ের ওপরই নির্ভর করে চলে আমাদের সংসার। মা বাড়ি থেকে শিঙাড়া, চপ ও ছোলা রান্না করে বাজারে দিয়ে আসেন। আমরা সেগুলো বিক্রি করে যা লাভ করি, তা দিয়েই কোনো রকম সংসার চলে যায়। আমরা যদি আর্থিক কোনো সহযোগিতা পেতাম, তাহলে ভালোভাবে চলতে পারতাম।
সাফিয়ার স্বামী শমসের আলী বলেন, ভাইরাস জ্বর হওয়ার পর আমার চোখের দৃষ্টি চলে যায়। এখন চোখে কিছুই দেখতে পাই না। আর ছেলে মাঠে কাজ করতে গিয়ে চোখে সমস্যা হয়। এরপর থেকে সেও আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আয়-রুজির কোনো পথ ছিল না। উজ্জলের মা বাড়িতে চপ, শিঙাড়া, পেঁয়াজু ও ছোলা রান্না করে বাড়িতে বিক্রি শুরু করে। কিন্তু বেচাবিক্রি ভালো হতো না। পরে পাশের একটা বাজারে বিক্রি শুরু করি। এদিকে আমি স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে যাই। তখন ছেলে দায়িত্ব নেয়।
সাফিয়া খাতুন বলেন, বিয়ের কয়েক বছর পর স্বামী ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চোখের দৃষ্টি হারায়। অল্প বয়সে বড় ছেলেরও চোখের আলো নিভে যায়। এ অবস্থায় কী করব, কোথায় যাব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। মাথায় চিন্তা আসে কারও কাছে হাত না পেতে নিজেরাই কিছু করে সংসার চালাতে হবে। তখন চিন্তা করি চপ-শিঙাড়া বিক্রি করার।
বাজারে একটি দোকানের আকুতি জানিয়ে সাফিয়া বলেন, আমাদের কোনো দোকান না থাকায় প্রথমে বাড়িতে চপ-শিঙাড়া বিক্রি করতাম। পরে বাজারে অন্যের একটা ভাঙা দোকানে বসে ওগুলো আমার স্বামী বিক্রি করত। এগুলো বিক্রি করে যে উপার্জন হয়, তা দিয়েই আমাদের সংসার কোনোরকমে চলে। ছোট ছেলেটাও বিয়ের পর থেকে আলাদা হয়েছে। আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না।
শৈলকুপা পৌরসভার মেয়র কাজী আশরাফুল আজম জানান, শমসের আলী ও তার ছেলে উজ্জল দুজনই কোনো এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হয়ে যায়। তাদের পরিবারে ছোট ছেলে ছাড়া উপার্জনক্ষম কেউ ছিল না। কিন্তু সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন ওই পরিবারে সুস্থ আছেন শমসের আলীর স্ত্রী। তিনি বাড়িতে চপ-শিঙাড়া রান্না করে দেন, সেগুলোই বাবা-ছেলে বিক্রি করেন। তবে তাদের তৈরি খাবারগুলো খুবই সুস্বাদু হয় বলে জেনেছি।
তিনি আরও বলেন, চাহিদা থাকলেও পুঁজির অভাবে ব্যবসা বাড়াতে পারছেন না তারা। পৌরসভার পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তবে সাফিয়া খাতুন সমাজের একজন সংগ্রামী মা।
এনএ