হামার ঈদ শ্যাষ
‘সামনত একটা ঈদ, যে কয় টাকা জোগাড় করছু ছোয়াচোটকগুলা(ছেলে-মেয়ে) নিয়ে ঈদ করবার জন্যে। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ে মোর সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়া যাবে ভাবিয়ার পারো নাই। এখন ভাঙা বাড়িঘর ভালো করতে টাকা লাগিবে। মুই ভ্যান চালে দিন আনো দিন খাও। এলা বাড়িঘর ঠিক করার টাকা পাম কোঠে, ঈদ করমো কি দিয়া, সব বুদ্ধি শেষ হয়া গেছে। হামার ঈদ শ্যাষ এলা যদি কাহো মোক সাহায্য-সহযোগিতা করলে হয় তাহলে একনা দম পানু হয়।’
কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার বগুলাগাড়ী এলাকার ভ্যানচালক ওহিদুল ইসলাম। গত শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) রাতের কালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে তার ঘরের চালা, ভেঙে গেছে ঘরের বেড়া। শুধু ওহিদুলই নয়, এমন আহাজারি করছেন ওই এলাকার অনেকেই।
কালবৈশাখী ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে নীলফামারীর ছয় উপজেলা ও চার পৌরসভার কয়েকটি এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি। ঝড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে ঈদ উদযাপনের পরিবর্তে চরম হতাশায় দিন কাটছে অসহায় ওই পরিবারগুলোর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার মধ্যরাতে জেলা সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলা থেমে থেমে কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। বৃষ্টির পানির চেয়ে শিলার তোপে মাটিতে নুয়ে পড়ে কৃষকের সবুজ ক্ষেত। এতে বেশকিছু এলাকার অনেক কাঁচাপাকা ঘরের টিনের চালা বাতাসে উড়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার ও খুঁটি উপড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গাছপালা ভেঙে রাস্তায় পড়ে থাকায় চলাচলের বিঘ্ন ঘটে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে হতভাগা মানুষগুলোর। তাদের মধ্যে ঈদের কোনো আনন্দ নেই, আছে শুধু বিষাদ। ঘর নেই, থাকার জায়গা নেই, খাবারও নেই।
পৌরসভার আকালী বেচাটারী এলাকার সোহরাব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রাইতোত বউ-ছাওয়া নিয়া ঘুমাইছি। হঠাৎ করি বাতাসের ধাক্কাত আম গাছ ভাঙ্গি পড়ি ঘরটা নষ্ট হইল। কোনো মতন করি বউ-ছাওয়া ধরি ঘর থাকি বেড়ে আসি বাঁচিছি। এলা যে মুই ঘরটা ঠিক করিম কোনো দিসাই পাছো না। সামনত ফির ঈদ আইচে, ছাওয়াগুলা কান্দেচে জামাকাপড়ের জন্যে।’
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে অসহায় পরিবারগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছেন জানিয়ে জলঢাকা পৌরসভার মেয়র ইলিয়াছ হোসেন বাবুল বলেন, এর আগে এমন ঝড়ের ক্ষতি দেখিনি। শুক্রবার রাতের ঝড়ে পৌর এলাকার প্রতিটি পাড়ামহল্লা তছনছ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থদের পৌরসভার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করা হবে।
সদর উপজেলার ইটাখোলা পূর্ব চৌধুরীপাড়া এলাকার দিনমজুর আশরাফ আলী বলেন, ‘রাইতে হঠাৎ করি বাতাস শুরু হইল। ওই বাতাসোত হুরমুরকরি মোর কাচা ঘরের ওপর গাছ পড়ি ঘরটা ভাঙ্গি পড়িল। মুই গরিব মানষি, এলা ঘর কেমন করি ভালো করিম ভাবিবার পারেছ না। ঘর ঠিক করির যায়া মোর আর ঈদ হয় না।’
টুপামারী দোগাছী গ্রামের সাদ্দাম আলী বলেন, হঠাৎ করে ঝড় শুরু হওয়ায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ সময় গ্রামের প্রায় শতাধিক কাঁচা ঘরের টিনের চাল বাতাসে উড়ে যায়। ভেঙে ও উপড়ে পড়ে বেশ কিছু গাছপালা। পূর্ব কোনো লক্ষণ না থাকায় মানুষের প্রস্তুতি ছিল না। এতে করে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।
নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুক্রবার জেলা সদর, কিশোরগঞ্জ, জলঢাকা ও সৈয়দপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ঝড় বয়ে যায়। কোথাও কোথাও ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ে ৮১৬ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভুট্টা ৫০০ হেক্টর, বোরো ধান ২৫০ হেক্টর এবং মরিচসহ অন্য শাক-সবজি ৬৬ হেক্টর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে।
নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন নাহার বলেন, শুক্রবার রাতের কালবৈশাখীর তাণ্ডবে জেলা সদরের ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও বলা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ করছেন। তাদের কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হবে।
নীলফামারী ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মিয়ারাজ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে সড়কের দুই পাশে শত শত গাছের ডালপালা ভেঙে গিয়ে সড়কে পড়েছে। কিছু কিছু জায়গায় এলাকাবাসীর সহায়তায় আবার কোথায় কোথাও ফায়ার সার্ভিসের টিম গাছগুলো সড়ক থেকে সড়িয়ে দিয়েছে।
নীলফামারী বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিপণন বিভাগ নেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নওশাদ আলম বলেন, শুক্রবার রাতের ঝড়ে সরবরাহ লাইনের ১৩টি খুঁটি ভেঙে পড়েছে। বড় বড় গাছ পড়ে সরবরাহ লাইনের তার ছিঁড়েছে। শনিবার আংশিক কিছু লাইন চালু করা গেলেও রোববার দুপুর পর্যন্ত শহরের সকল লাইন চালু করা সম্ভব হয়নি। বন্ধ থাকা লাইনগুলো চালু করতে আরও কিছু সময় লাগবে।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ঝড়ে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়া ছাড়াও ৮১৬ হেক্টর কৃষিজমির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে- এ রকম তথ্য আমরা পেয়েছি। আর প্রায় ১৬০০ ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করছেন। খোঁজখবর নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।
শরিফুল ইসলাম/আরএআর