মাটির চাকিতেই ঘুরছে জীবনের চাকা
ছোটবেলায় মনের অজান্তে মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করতে গিয়ে কুমোর জীবনের সঙ্গ জড়িয়ে পড়েন মঞ্জুরী পাল। স্বামীর সংসারে এসেও একই কাজ করছেন। রাত-দিন কাদামাটির কাজ করে হয়ে গেছেন মাটির মানুষ। শুধু মঞ্জুরী পাল নয়, এটা মেহেরপুরের গাংনীর আমতৈল গ্রামের প্রতিটি পরিবারের জীবনচিত্র।
মঞ্জুরী পালের সংসারে রয়েছে এক মেয়ে ও দুই ছেলে। জায়গা-জমি নেই। কুমোরের কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে এমএ পাস করে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। ছোট ছেলে পড়ছেন উচ্চ মাধ্যমিকে।
জানা গেছে, কৃষিতে লোকসান ও অন্য ব্যবসা করার মতো অর্থ না থাকায় বাধ্য হয়ে গাংনীর আমতৈল গ্রামের মানুষ পোড়া মাটির চাকি তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তবে প্লাস্টিকের চমকপ্রদ দ্রব্যাদির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নিপুণ শিল্পকর্ম খচিত মাটির জিনিসের কদর কমে গেছে। ফলে দৈন্যদশা বিরাজ করছে কুমোরদের মাঝে। স্বল্প সুদে ঋণ পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন কুমোররা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠানে পরিবারের সকলে মিলে মাটি দিয়ে তৈরি করছেন রিং বা চাকি। দু-একটি পরিবার মিলে চাকি পোড়ানোর জন্য তৈরি করে রেখেছেন চুল্লি বা ভাটা। ভাটায় থরে থরে শুকনা মাটির রিং সাজিয়ে জ্বালানো হচ্ছে। সাদা মাটির চাকি দুদিন জ্বালানোর পর পরিণত হচ্ছে লালচে বর্ণের। গ্রামে প্রবেশ করলেই মনে হচ্ছে পুরো গ্রামকে যেন সাজানো হয়েছে পোড়া মাটির লালচে রংয়ের মাটির চাকি দিয়ে।
মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে আমতৈল গ্রাম। গ্রামের অন্তত ৩০টি কারখানায় দুই শতাধিক পরিবারের লোকজন মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। নারী-পুরুষ সবারই কাদামাটির গন্ধমাখা শরীর। এক সময় নিত্য ব্যবহার্য বাসনপত্র, ফুলের টব, নান্দা, খেলনাসহ কারুকাজ করা শোপিসের বেশ কদর ছিল। বর্তমানে অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসের কদর বেড়ে যাওয়ায় মাটির তৈরি জিনিসের আর কদর নেই। এখন পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মাটির পাট বা চাকি। জেলার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলাতেও বিক্রি হচ্ছে এসব চাকি।
চাকি কারখানার মালিক স্বপন জানান, আগে এক ট্রলি মাটির দাম ছিল ২০০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০০০ টাকা। জ্বালানির দামও বেড়ে গেছে। কারখানার মালামাল তৈরি ও চুলার জন্য জমি লিজ নিতে হয়। এক বিঘা জমি লিজ নিতে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হয়। বছরের মাত্র ৮-৯ মাস চলে এ ব্যবসা। অনেক কুমোর বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে মৃৎশিল্পে বিনিয়োগ করেছেন। আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে এমন কোনো টাকা থাকে না, যা দিয়ে সমিতির কিস্তি পরিশোধ করবেন। সরকার যদি স্বল্প সুদে কুমোরদের ঋণের ব্যবস্থা করতেন তাহলে সকলেই স্বাবলম্বী হতে পারত।
ওই গ্রামের সুশান্ত নামে এক ব্যক্তি জানায়, এক সময় শুধু হিন্দু ধর্মের লোক মাটির জিনিসপত্র তৈরি ও বিক্রির কাজে জড়িত ছিল। এখন আস্তে আস্তে গ্রামের সব ধর্মের মানুষ এ কাজে নিয়োজিত। এখন এলাকায় মাটির কদর বেড়েছে।
কারখানা মালিক হবিবর রহমান জানায়, আমাদের গ্রামের নাম আমতৈল হলেও আশপাশের লোকজন আমাদের ডাকে চাকির গ্রামের মানুষ। গ্রামের যে বাড়িতেই যাাবেন, দেখবেন পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও বাড়ির উঠনে মাটির চাকি তৈরিতে ব্যস্ত। দুএকটি বাড়ির পর পর চাকি পোড়ানোর ভাটা দেখা যায়।
গাংনী উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মোহাম্মদ খোকন রেজা বলেন, আমতৈল গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মাটির চাকি তৈরি করা হয়। চাকি পোড়ানোর জন্য চুল্লিতে বিভিন্ন ধরনের কাঠ এবং পোশাক কারখানার পরিত্যক্ত কাপড় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে কালো ধোঁয়ায় গ্রাম আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শিশুদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে এবং অল্প বয়সেই শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নতুন কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে চুল্লির ধোঁয়া অনেক ওপরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। তানাহলে খুব অল্প বয়সেই এই গ্রামের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে।
গাংনী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার কাজি আবুল মনসুর জানান, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য দুটি কর্মসূচি চালু করেছেন সরকার। একটি ভাতা কর্মসূচি অন্যটি ক্ষুদ্র ঋণ। ওই গ্রামের কুমোররা যদি ঋণের জন্য আবেদন করেন তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসপি