সুস্থ মানুষ ভাতা পায়, অথচ আমি পাই না
জন্ম থেকেই পিঠ ও বুকে রয়েছে কুঁজ। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। এ নিয়েই চলাফেরা করতে হয়। ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে কোনোরকম সংসারের হাল ধরতে হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী মোহাম্মদ রাজু মিয়াকে। অথচ জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়েও পাননি প্রতিবন্ধী ভাতা ও চালের কার্ড।
মোহাম্মদ রাজু মিয়া (২২) নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের শফি সর্দার বাড়ির দিনমজুর শহিদ উল্লাহর ছেলে। বাবা, স্ত্রী রোকসানা ও এক বছর বয়সী ছেলে ইব্রাহীম খলিলকে নিয়েই তার সংসার। তার মা মারা গেছেন।
দরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়ায় ছোটবেলা থেকেই সমাজে অবহেলিত। শারীরিক কারণে পড়ালেখাও করতে পারেননি। তাই অভাবের তাড়নায় আট বছর বয়সে রাজু মাছ বিক্রি শুরু করেন। এর দুই বছর পর জেলা শহর মাইজদীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো শুরু করেন।
গরিব ও প্রতিবন্ধী হয়েও পাননি ভাতা অথচ সুস্থ ও বড়লোকেরা পায় জানিয়ে আক্ষেপ করে রাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পিয়ন সোহেল আমার কাছ থেকে ১২০০ টাকা নিয়েছে। এখনো কোনো ভাতা পাইনি। ডিসি অফিস ও উপজেলা অফিসে কাগজ জমা দিয়েও পাই নাই। বড়লোক ও সুস্থ মানুষ ভাতা পায়, অথচ আমি পাই না। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১০ টাকার চালের কার্ডও পাই নাই।
রাজু আরও বলেন, অটোরিকশা চালিয়ে মালিকের জমার টাকা দেওয়ার পর দুই-তিন শ টাকা থাকে। এই টাকা দিয়ে সংসার চলে না। ইচ্ছে হলে সন্তানের জন্য কোনো ফলমূল কিনতে পারি না। আমার নিজের যদি একটি রিকশা থাকত, তাহলে ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতাম।
গরিব দিনমজুর পরিবারে জন্ম নেওয়া রাজু চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলের গণ্ডিতে পা দিতে পারেনি। তবে স্বপ্ন দেখেন ছেলেকে মাদরাসায় পড়াবেন যেন মানুষের জন্য দোয়া করতে পারেন। ‘আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। আমার ছেলেকে মাদরাসায় পড়ামু। আলেম বানামু যাতে সে মানুষের জন্য দোয়া করতে পারে’, বললেন রাজু।
ঈদের দিন পুরোনো কাপড় দিয়েই কাটে, এমনটা জানিয়ে রাজু বলেন, নতুন জামা কাপড় কিনতে পারি না। তাই পুরাতন কাপড় পরে কাটাই। মানুষ নতুন জামা পরে আর আমরা পুরাতন জামা পরে ঈদ করি। স্ত্রী-সন্তানকে জামা কিনে দিতে পারি না। ঈদে আমার কোনো আনন্দ নাই। সেমাই-চিনিও কিনতে পারি না।
রাজুর বাবা শহিদ উল্ল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জন্মের পর থেকে রাজুর অসুস্থতা দেখা দেয়। টাকার অভাবে ওর চিকিৎসা করাতে পারি নাই। এখন কোনো উপায় না থাকায় ভাড়ায় অটোরিকশা চালিয়ে অনেক কষ্টে বউ-ছেলে নিয়ে সংসার চালায়। আমার যদি কোনো কিছু হয়, তাহলে ওদের আর কোনো অবলম্বন থাকবে না।
রাজুর চাচা মোহাম্মদ বাবুল বলেন, সরকারের সহযোগিতা পেলে রাজু ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারবে। সরকার চাইলে অনেক কিছু পারে। এই অসহায় ছেলেটাকে একটা অটোরিকশা দিলে তাও দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারবে।
পরিষদের নিয়োগপ্রাপ্ত অফিস সহকারী সোহেল ভাতার কার্ডের জন্য ১২০০ টাকা নেওয়ার বিষয়ে নেয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমির হোসেন বাহাদুর ওমরাহ হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে অবস্থান করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে ইউপি সচিব শাহিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজুর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। কে বা কারা টাকা নিয়েছে, তাও জানা নেই। রাজুর প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড হয়ে যাওয়ার কথা। সমাজসেবা অফিস থেকে দেবে। ইউপি চেয়ারম্যান ওমরাহ হজের জন্য সৌদিতে আছেন। আমি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করে দেব।
নোয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিজাম উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পাবেন না, এটা দুঃখজনক। আমি দ্রুত কার্ডের ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া এ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা হবে।
তিনি আরও বলেন, রাজুর বিষয়ে আপনাদের থেকে শুনে অবাক হয়েছি। সাহায্য না চেয়ে এভাবে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়ানো সত্যিই বিরল ঘটনা। আমি তার বাড়িতে যাব। তাকে সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এর পাশাপাশি তার কর্মসংস্থানের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
এনএ