বিদ্যাময়ীর ছাত্রীদের চমক
পিরিয়ড, মাসিক বা ঋতুস্রাব প্রতিটি নারীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে শব্দগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে যেন অস্বস্তির। সমাজে এখনও ঋতুস্রাবকে অপবিত্র ও নোংরা ভাবা হয়। স্কুলগামী কিশোরীদের এ নিয়ে প্রায় সময়ই লজ্জায় ও বিপাকে পড়তে হয়। কারো সঙ্গে না বলে নিজেদের মধ্যে গোপন করে বয়ঃসন্ধিকালের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করে মেয়েরা।
তবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে অনন্য এক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ময়মনসিংহ নগরীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। বিদায় অনুষ্ঠানে নিজেদের চাঁদার টাকায় স্থাপন করেছে ‘হাইজিন স্যানিটারি ভেন্ডিং মেশিন’। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে এমন শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার বেলায় এমন চমক দেখিয়েছে।
বিদায় অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা তুলে দিবা শাখার ১৩৬ জন শিক্ষার্থী কিনেছে একটি হাইজিন স্যানিটারি ভেন্ডিং মেশিন। ২৫ হাজার টাকা খরচ করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত মেশিনটি বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে। পিরিয়ডের সময় গোপন রাখার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
সফ্টওয়্যারযুক্ত এই আধুনিক মেশিন বিদ্যালয়টিতে স্থাপনের কারণে হাতের কাছে সহজেই মিলবে স্যানিটারি প্যাড। এতে আর লজ্জায় পড়তে হবে না কোনো ছাত্রীকে। মেশিনটি নির্দিষ্ট একটি কার্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। শ্রেণি শিক্ষক, ক্লাস ক্যাপ্টেন ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে রয়েছে সেই কার্ড। কার্ডটি নিয়ে মেশিনের নির্দিষ্ট স্থানে ধরলেই বেরিয়ে আসবে স্যানিটারি প্যাড। মেশিন থেকে স্যানিটারি প্যাড শেষ হয়ে গেলে তা ফের পূর্ণ করে দেবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই। বিদায়ী ছাত্রীদের এমন অভাবনীয় উদ্যোগে মুগ্ধ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
প্রথম পরিকল্পনাকারী ছাত্রী নাবিহা জান্নাত প্রিয়তি বলেন, ‘ঢাকায় অনেক পাবলিক টয়লেটে ব্যবস্থাটি রয়েছে। অনলাইনে মেশিন সম্পর্কে জানার পর নিজের বিদ্যালয়ে ছোট বোনদের জন্য এটি স্থাপন করা যায় কি না তা বান্ধবীদের সঙ্গে আলাপ করি। নিজেরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, আমাদের ছোট বোনরা যেন সেই সমস্যার মুখোমুখি না হয়, সেজন্য বান্ধবীরা চাঁদা তুলে মেশিনটি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
সায়ন্তী মজুমদার নামে আরেক ছাত্রী বলেন, ‘অনেকের ছোট বয়সে পিরিয়ড হয়। আমাদের ছোটদের যেন এই সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য এই উদ্যোগ। এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করলে এবং ব্যবহার করলে কাউকে লজ্জায় পড়তে হবে না।’
বিদ্যালয়টিতে এ বছর দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে লুবনা তাসনিম লাবণ্য। সে জানায়, মেয়েদের বয়ঃসন্ধির সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে এই সময়টি ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকে, বিদ্যালয়ে আসে না। কিন্তু মেশিনটি স্থাপন হওয়ায় ছাত্রীদের সমস্যা অনেকটা কমে আসবে।’
বিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আয়েশা আক্তার বলেন, বিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষকের কাছে কিছু ন্যাপকিন কিনে রাখা হতো। বাচ্চারা অনেক সময় কষ্ট হলেও বলতে চাইত না। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগটি যুগান্তকারী ও সারা দেশের মাইলফলক।
ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বলেন, শিক্ষার্থীদের উদ্যোগটি অবশ্যই ইতিবাচক। এখনকার ছেলে-মেয়েরাই নানাভাবেই টাকা নষ্ট করে, কিন্তু তারা সেটি না করে ছোট বোনদের কথা চিন্তা করে মেশিনটি দিয়েছে। এটি একটি বড় চিন্তা। এমন উদ্যোগ গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি নেওয়া যায়, তাহলে অনেক উপকার হবে। কারণ গ্রামে এখনও পিরিয়ডকালীন সময়টিকে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। গ্রামে মেয়েরা পিরিয়ডের সময়ে যে কাপড় ব্যবহার করে তা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।
ময়মনসিংহ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৩ সালে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে পাঠদান চলে। বর্তমানে এতে ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ১১৯ জন।
উবায়দুল হক/এসপি