রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন, কিন্তু স্বীকৃতি নেই মুক্তিযোদ্ধার
২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন শামু। মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। তবে সরকারিভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি।
পরিবারের কাছে আছে যাবতীয় সনদ; সহযোদ্ধারা বারবার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবু জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর পৌর সদরের পূর্ব দীপেশ্বর গ্রামের প্রয়াত শামসুদ্দিন শামু।
পরিবারের দাবি, উপজেলা ও জেলা থেকে বারবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নামে প্রতিবেদন পাঠানো হলেও মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে না পারায় স্বীকৃতি মেলেনি তার।
এলাকাবাসী ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের পৌর সদরের পূর্ব দীপেশ্বর গ্রামের মৃত সেলামতের ছেলে শামসুদ্দিন শামু। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তার এক ভাই পাক বাহিনীর দোসরদের হাতে শহিদ হন। এ ঘটনার পর ভারতে চলে যান শামু। সেখানে অম্পিনগর ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে তার সহোদর অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনিং নিয়ে ১১ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ কারণে এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম কাতারে বরাবরই নাম ও অবস্থান ছিল তার। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য বারবার অনুষ্ঠিত যাচাই-বাছাইয়েও তার নাম ছিল।
৯ ছেলে-মেয়ের সংসার চালাতে গিয়ে রিকশা চালাতে হয় মুক্তিযোদ্ধা শামুকে। ঢাকায় অবস্থানকালে ২০১৮ সালের দিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে দেখা করে নিজের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির আবেদন জানান। মন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন তাকে; সুপারিশ করেছিলেন তার আবেদনপত্রে। কিন্তু তাতেও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) লালফিতার গিঁট খোলেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বীকৃতি পাননি শামু।
প্রয়াত শামসুদ্দিন শামুর দ্বিতীয় মেয়ে মঞ্জিলা আক্তার ঢাকা পোস্টকে জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানের স্বীকৃতি আদায়ে আজও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
মঞ্জিলা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়েও উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত করা হয় শামসুদ্দিন শামুকে। তালিকায় তার নাম ছিল ৯ নম্বরে। কিন্তু পাঁচ লাখ টাকা দিতে না পারায় তার বাবার নামের স্থলে অন্য ব্যক্তির নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। যাতে তার মা মারা যাওয়ার আগে স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেন।
অবশ্য কে বা কারা তাদের কাছে ৫ লাখ টাকা উৎকোচ চেয়েছে তাদের নাম জানাতে রাজি হননি মঞ্জিলা আক্তার। তিনি আশঙ্কায় আছেন, এতে এখনো যে আশাটুকু আছে তাও ভেস্তে যেতে পারে।
শামসুদ্দিন শামুর ছবি হাতে সহধর্মিণী নূরেন্নেছা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামীর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হয়েছে। এতে আমি খুশি। কিন্তু আমি ও আমার পরিবার মুক্তিযোদ্ধার কোনো সুযোগ-সুবিধা এখনো পাই না। মৃত্যুর আগে আমি স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেখে যেতে চাই।
হোসেনপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন শামু তার সঙ্গে ভারতের অম্পিনগরে ট্রেনিং নিয়ে ১১ নং সেক্টরের অধীন যুদ্ধ করেছেন। এমনকি কিশোরগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে প্যারাভাঙ্গার ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধেও তিনি তার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় শামুর নাম না থাকার ঘটনাকে নিষ্ঠুর পরিহাস ও জাতির জন্য লজ্জার বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন উপজেলা কমান্ডার।
হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাবেয়া পারভেজ ঢাকা পোস্টকে জানান, মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সম্মান পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সব ধরনের সনদ আছে। এমনকি উপজেলা প্রশাসন থেকে পজিটিভ রিপোর্ট যাওয়ার পরও কীভাবে জামুকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে, তা বলতে পারলাম না।
তবে জামুকা থেকে আবারও যদি প্রতিবেদন চাওয়া হয় কিংবা ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজনও যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তবে এ বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সহায়তা করবেন বলে জানান তিনি।
এনএ/জেএস