প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে ছুটে চলেন গ্র্যাজুয়েট শাপলা
ছোট থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী, পরিবারে ছিল আর্থিক অনটন। অবহেলা-বঞ্চনার শিকার হয়েছেন পদে পদে। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে আজ তিনি সমাজের বোঝা নন। উচ্চশিক্ষিত হয়েও ভ্যান চালিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করছেন। গ্রাম থেকে শহরে ছুটে বেড়াচ্ছেন। তিনি শাপলা খাতুন (৩২)।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের হরিপুর গ্রামের মন্ডল পাড়ার চাঁদ আলীর মেয়ে শাপলা। তার মায়ের নাম জোছনা খাতুন। চার ভাই-বোনের মধ্যে শাপলা দ্বিতীয়। সবার বড় একমাত্র ভাই আর তিন বোনের মধ্যে বড় শাপলা। সবার বিয়ে হয়ে গেছে।
শাপলা ভালোবেসে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে কুষ্টিয়া শহরের হরিশংকরপুর এলাকার আব্দুস সালামকে বিয়ে করেন। প্রতিবন্ধী হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের বিয়ে মেনে নেয়নি। তাই বাবার বাড়িতে থাকেন। এক বছর আগে তাদের বিয়ে মেনে নেয় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
পারিবারিকভাবে জানা যায়, প্রথমে স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন শাপলা। তারপর ভর্তি হন হাটশ হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর বিএম কুষ্টিয়া হাই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন। কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০১০ সালে একই কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন।
ছোট থেকেই মেধাবী শারীরিক প্রতিবন্ধী শাপলা গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরও অনেকভাবে অবহেলার শিকার হয়েছেন। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেছেন। না পেয়ে বেসরকারি চাকরি পেতেও ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে। কিন্তু সেখানেও ঠাঁই হয়নি। কারণ, তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবু দমে যাননি। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বিভিন্ন সংগঠন ও সেবামূলক কাজ করছেন।
শাপলা খাতুনের স্বামী আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্ত্রী শাপলা খাতুন খুব পরিশ্রমী মানুষ। ফার্নিচার, খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করে। সে ব্যবসা করে সফল হয়েছে। তা ছাড়া সংগঠনের নেতা হিসেবে এলাকার প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করছে। স্ত্রীকে নিয়ে আমি গর্ব করি।
চারদিকে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা সইতে না পেরে তার জেদ হলো। তখন ভাবতে লাগলেন নিজের পরিবার ও ভবিষ্যতের জন্য কিছু একটা করতেই হবে। মাথায় ব্যবসা করার চিন্তা এল। প্রথমে ভ্যান চালানো শিখলেন। পরে একটি ভ্যান কিনলেন। ২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১৭ সালে চালের ব্যবসা শুরু করেন। আজ শাপলা সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার সব কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
শাপলা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। অর্থের অভাবে কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের সংগঠনে প্রজেক্টের মাধ্যমে কাজ শুরুর পর তারা বেতন দিত। তা ছাড়া কোনো মিটিং বা অনুষ্ঠান হলেও টাকা পেতাম। সংগঠনের কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তাদের বিভিন্ন সহায়তা দিই।
সরকারি চাকরির জন্য বহুবার চেষ্টা করেছি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি চাকরি কপালে জোটেনি। এ জন্য ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালানো শিখি। তারপর ২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১৭ সালে চালের ব্যবসা শুরু করি। কুষ্টিয়া শহর থেকে চাল কিনে এনে বিভিন্ন গ্রামে সেগুলো বিক্রি করি। আমার সাথে ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আব্দুল হালিম ভাই যুক্ত আছেন। সে আর আমি সারাদিন ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত সময় পার করি। আস্তে আস্তে আমাদের পুঁজি ও ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা অনেক ভালো আছি।
সফল হতে হলে ধৈর্য আর সাহস লাগে। শাপলা বলেন, আমি অন্যের ওপর নির্ভরশীল নই। অনেক বাধা পেরিয়ে আমি সফল হয়েছি। বর্তমানে আমি অনেক ভালো আছি এখন, সুখে আছি। অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না আমাকে। চেষ্টা করি সবার জন্য কিছু করার। ব্যবসা করে টাকা জমিয়েছি, বাড়ি করেছি। আগামীতে ব্যবসার পরিধি আরও বাড়াতে চাই। আমার মতো যারা সমাজে অবহেলিত, সেসব প্রতিবন্ধীর কল্যাণে কাজ করতে চাই।
শাপলা খাতুনের ব্যবসায়িক পার্টনার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আব্দুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিশ্রমের মাধ্যমে শাপলা আপা সফল হয়েছেন। সকালে ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালিয়ে আপা শহরে যান। প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ভ্যানে করে গ্রামে ফিরে আসেন এবং গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দেন। পুরোটা সময় আমি আপার সাথে থাকি। চারপাশে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তিনি খুব ভালো ও সফল মানুষ। তার সাথে থেকে আমিও সফল হয়েছি।
মেয়েকে নিয়ে একসময় সমাজে অনেক বিপদে পড়েছেন শাপলার মা। নিজের মেয়েকে মানুষ তিরস্কার করত বলে চাপাকান্না সব সময় ছিল তার চোখে। কিন্তু আজ যখন দেখেলেন মেয়ে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করলেন, তখন পেছনের সব দুঃখ ভুলে গেছেন।
শাপলা খাতুনের মা জোছনা খাতুন বলেন, তিন মাস বয়সে শাপলার জ্বর হয়েছিল। তারপর থেকে পায়ে শক্তি পান না। অনেক চিকিৎসা করিয়েছিলাম কিন্তু সুস্থ হয়নি। সুস্থ মানুষের মতো চলাফেরা করতে না পারলেও আমার মেয়ে প্রচণ্ড মেধাবী ও পরিশ্রমী। ছোট থেকেই কাজের প্রতি একাগ্রতা ছিল।
তিনি আরও বলেন, মেয়ে প্রতিবন্ধী বলে চাকরি হলো না। মেয়ের জন্য নানা খারাপ কথা শুনতে হয়েছে। আমি নিজে মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়েছি। যেমনটা হয় প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেওয়া যে কোনো মায়ের ক্ষেত্রেই।
তবে আজ ৩২ বছরের শাপলা খাতুন প্রমাণ করেছে, সব প্রতিবন্ধকতাই হারিয়ে দেওয়া যায় আত্মবিশ্বাস দিয়ে। সেদিনের ভেঙে পড়া মায়ের কাছে আজ আর শাপলা কোনো ব্যর্থতা নন, শাপলা তার গর্ব। শত বাধা পেরিয়ে শাপলা সফল হয়েছে।
স্থানীয় ও প্রতিবেশীরা বলেন, প্রতিবন্ধী হলেও অনেক বাধা পেরিয়ে শাপলা খাতুন পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন। অন্যের বোঝা না হয়ে নিজে পায়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি খুবই ভালো মানুষ। এলাকার অসহায় মানুষ ও প্রতিবন্ধী মানুষকে সহযোগিতা করেন। এ কারণে এলাকার মানুষ তাকে খুবই ভালোবাসে। আল্লাহ খুব সুখে রেখেছেন শাপলাকে।
হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম মুশতাক হোসেন মাসুদ বলেন, শাপলা খাতুন প্রতিবন্ধী নারী হয়েও উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন। সেবামূলক কার্যক্রমে যুক্ত। ইঞ্জিনচালিত ভ্যান নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে বেড়ান। ফার্নিচার ও খাদ্যসামগ্রীর ব্যবসা করেন। শহর থেকে ভ্যানে করে পণ্য বহন করে গ্রামের গ্রাহকদের দরজায় পৌঁছে দেন। একজন নারী হয়েও ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন, সফলতা পেয়েছেন, এটা সমাজের জন্য বিশাল ব্যাপার। এলাকায় তিনি সুনাম অর্জন করেছেন।
কুষ্টিয়া জেলা সমাজসেবা অফিসের উপপরিচালক মুহাম্মদ মুরাদ হোসেন বলেন, শাপলা খাতুন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করে সফল ও স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সব প্রতিবন্ধীর জন্য শাপলা অনুপ্রেরণার নাম। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে তিনি আরও সফল হবেন। সমাজসেবা অফিসের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে ইনশা আল্লাহ হাত বাড়িয়ে দেব।
এনএ