কলাগাছের শহীদ মিনার ও একটি নির্ঘুম রাত
একটি কলাগাছের শহীদ মিনার, সারিসারি কাগজের পতাকা টানানো চারপাশে, সকাল হতেই কিছু মানুষের খালি পায়ে জোর চিৎকার ‘শহীদের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’। অথবা চারপাশে মাইকের শব্দ, ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’
আপনার ভাবনার আকাশে যদি ভেসে ওঠে একুশ, একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস তাহলে আপনার মফস্বলের সেই সকালের স্মৃতি রোমন্থন করানোর আশায় এই লেখা লিখতে বসা। আপনি হয়তো নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়েন। অজপাড়াগাঁয়ের কোনো স্কুলে। পাকা শহীদ মিনার নেই। নেই আরও অনেক কিছু। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বছরজুড়ে রোমাঞ্চিত হন। ক্লাস নাইন অবধি আপনি সেই কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পারেন না। আপনার একটু বড় হতে ইচ্ছে হয়, কলাগাছের শহীদ মিনার বানানোর জন্য হলেও। সারিসারি পতাকা টাঙাতে পারার জন্যও।
একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখে শুরু হয় ব্যস্ততা। সকাল গড়িয়ে বিকেল নামতেই শুরু হয় কলাগাছের খোঁজ। গ্রামের এই মাথা থেকে ওই মাথা ছুঁটে চলা। আপনি হয়তো ভয়ে ভয়ে কোনো একজনের কলাগাছ কেটে ফেলেন, মালিকের ধাওয়া খেয়ে পালিয়েও আসেন।
আপনার তিনটা কলাগাছ দরকার। দুইটা বড়, একটা ছোট। খোঁজ চলতে থাকে সন্ধ্যা নেমে এলেও। অবশেষে পেয়ে যান সেটা। কাঙ্ক্ষিত তিন কলাগাছ। আপনারা মাইক ভাড়া করেছেন, সেখানে দেশের গান বাজছে। আপনাদের কাজও চলছে সমান তালে।
প্রয়োজনীয় কাপড়, কাগজের পতাকা আর সুতোর মতো দঁড়ি নিয়ে হাজির হয়েছেন একজন। আপনাদের শাবল খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হতে হচ্ছে, দা পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি হয়তো রেগে যাচ্ছেন হঠাৎ, আবার পরক্ষণেই হাসছেন, আড্ডায় মেতে উঠছেন আপনার বন্ধুদের সঙ্গে। এই স্মৃতি কি আপনি ভুলে গেছেন?
অথবা শাবল দিয়ে মাটি খোঁড়ার দৃশ্য। কিংবা কলাগাছ নিয়ে তেরো-চৌদ্দ বছরের আপনাদের সেই হাপিত্যেস, মাটিতে পুঁতে দিয়ে পাওয়া স্বস্তি। তখন হয়তো আপনি খেয়াল করলেন রাত দুইটা বেজে গেছে। চারপাশে ঝিঁঝিঁপোঁকার ডাক বেড়ে গেছে বহুগুণ। কুয়াশা ঘিরে ধরেছে সব। তীব্র শীত বেড়েছে আরও। কিন্তু আপনি তখনো খেতে পারেননি।
এমনিতে আটটা-নয়টাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট। রাত দুইটা মানে অনেক রাত, মফস্বলের জন্য প্রায় ভোর। আপনারা সব বন্ধুরা মিলে তখন খেতে বসেছেন। আদতে আলোচনায় বসেছেন এরপর আরও কী কী করতে হবে। খাওয়া শেষেই মাটির জন্য দৌড়াতে হবে। কাঠ চেঁড়া কুঁড়ো লাগবে।
মাটি দিয়ে শহীদ মিনারের সিঁড়ি না হয় তৈরি হলো। কিন্তু সেটাতো পুরোপুরি ঠিকঠাক হলো না। পানি ঢালতে হবে। তাতে কুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আপনি রাত তিনটায় কুঁড়ো কোথায় পাবেন? আপনার বন্ধুদের মধ্যে সাহসী কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে হবে। কিন্তু রাত তিনটায় দূরে চোখ রাখাও দায় যখন, তখন কে নামবে স’মিলে কুঁড়ো আনতে?
আপনি কাউকে পেলেন না। এক বন্ধুকে নিলেন। সঙ্গে ছোট্ট একটি টর্চ লাইট। ভীরু চোখে শুরু হলো পথচলা। এক পা, দুই পা, এরপর একসময় স’মিল। কুঁড়ো নিতে নামলেন যখন, ঘড়ির কাঁটায় তিনটা পাঁচ।
কুঁড়ো নিয়ে ফিরে আসতে আসতে চারটা বেজে গেছে। শহীদ মিনার প্রস্তুত হয়েছে। কাগজের পতাকা আটকে দেয়া হয়েছে দেয়ালে। সারিসারি পতাকা টাঙিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে সবটা। সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে পূর্বাকাশে।
রৌদ্দুরের লুকোচুরিতে দৃশ্যমান হয়ে গেছে আপনাদের সারারাতের কষ্ট। লাল আর সবুজ রঙে ভরে উঠেছে স্কুলমাঠ। লোকজন আসছে, দেখছে। আপনি দূর থেকে সেসব উপভোগ করেছেন। ততক্ষণে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে। ঘুমাতে পারছেন না তখনো।
মিছিলে যেতে হবে, খালি পায়ে। কখনো পাকা রাস্তা, কখনো ধান ক্ষেতের পাশে পথ। আপনি স্লোগান দিতে শুরু করলেন, ‘জব্বারের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’। ‘আজকের এই দিনে, রফিক তোমায় মনে পড়ে’। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সব। ঘুম জড়িয়ে আসে আরও বেশি। আপনি হয়তো দৌড়ে চলে যান স্কুলের পাশে আপনার বাড়িতে। গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মুহূর্তে। সারাজীবন গল্প করার মতো একটি গলাগাছের শহীদ মিনার, নির্ঘুম রাত ও একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে।
এইচএন/এএ