মহিষের দইয়ে ক্ষতিকর অণুজীবের উপস্থিতি
মহিষের দই আগাগোড়াই লোভনীয়। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠানে মহিষের দইয়ের ব্যবহার বহু পুরোনো। তবে দেশীয় মহিষের দইয়ে ক্ষতিকর অণুজীব এবং ছত্রাকের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক। যা মানবদেহে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। দইয়ের সব অণুজীব এবং ছত্রাক একসঙ্গে চিহ্নিতকরণের গবেষণা এটিই বাংলাদেশে প্রথম।
দুই বছর ধরে চলা এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল- দইয়ের মধ্যে পুষ্টিগুণের তুলনা, ভারী ধাতব ও এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি যাচাই। এই গবেষণার নমুনা বিশ্লেষণ করে তথ্য সুনিশ্চিতকরণের কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্যারি মার্শালের গবেষণাগারের গবেষকরা।
নেচার রিসার্চের ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম। সহযোগী ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএসআইআর, বন গবেষণাগার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, রংপুর, মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা রকমের দই সংগ্রহ করেন গবেষকরা।
এসব দইয়ের মধ্যে গরুর টক দই ও মিষ্টি দই এবং মহিষের টক দই মিলিয়ে মোট ৩০৬ রকমের অণুজীব শনাক্ত করেন তারা। এর মধ্যে ২৮ রকমের অণুজীব সবগুলো দইয়ে পাওয়ার কথা জানান তারা। এতে ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং স্ট্রেপটোকক্কাস ছাড়াও ল্যাক্টোকক্কাস ও এরোমোনাস ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে বেশিরভাগ দইয়ে। আর মিষ্টি দইয়ে মিলেছে ক্ল্যাভেরোমাইসেস ও ক্যান্ডিডা ছত্রাকের আধিক্য।
মহিষের দইয়ে যেসব অণুজীব পাওয়া গেছে তা মানবদেহের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী হতে পারে। যেমন পাকস্থলীর সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এদের মধ্যে এন্টারোব্যাকটার প্রজাতির অণুজীব সাধারণত গবাদি পশুর মলমূত্রে পাওয়া যায়, যা প্রাণীর অন্ত্র সংক্রমণের জন্য দায়ী। এছাড়াও মহিষের দইয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছত্রাক পাওয়া গেছে যাতে আছে ক্যান্ডিডা, আয়োডোফেনাস, এপিওট্রাইকাম ও ট্রাইকোস্পোরন। এই ছত্রাকগুলো চুলকানি ও চামড়ায় সংক্রমণ, হজমে সমস্যা এবং রক্তে বিষক্রিয়ার জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী।
গবেষকরা মনে করেন, মহিষের দই এর লবণাক্ত এবং ভিন্ন মাত্রার স্বাদ অবিক্রিত রাখার জন্য দুধ থেকে দই প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোটানো হয় না, যা দইয়ে সংক্রামক অণুজীবের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে তুলনামূলকভাবে মিষ্টি দইয়ে উপকারী অণুজীবের পরিমাণ কম এবং কয়েকটি ধরনে স্ট্রেপটোকক্কাস অণুজীবের পাশাপাশি ক্ল্যাভিসপোরা প্রজাতির ছত্রাকের বিপুল পরিমাণে উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকরা। এর পেছনে অতিরিক্ত চিনি বা অন্যান্য দ্রব্য মেশানো একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা। ক্ল্যাভিসপোরা অতিরিক্ত চিনির উপস্থিতিতে বসবাস করতে পারে। এটি সরাসরি কোনো রোগের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী না হলেও খাবারকে তাড়াতাড়ি পচিয়ে ফেলতে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, পুষ্টিগুণের দিক থেকে টক দই অনেক বেশি এগিয়ে। টক দইয়ের সবগুলো ধরনে উপকারী খনিজ যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে, যা মিষ্টি দইয়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু বেশ কিছু ব্রান্ডে দইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘জিঙ্ক’ পাওয়া যায়নি। যা মানবদেহের গঠন, বিকাশ ও প্রজননে সাহায্য করে।
অন্যদিকে পাঁচ ধরনের দইয়ে কপারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি মাত্রায়। তবে তা বিশেষ ক্ষতিকারক মাত্রায় পাওয়া যায়নি।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে যেহেতু বিএসটিআই অনুমোদিত খুব বেশি মহিষের দই নেই, তাই একটি মাত্র জনপ্রিয় মহিষের দইয়ের নমুনা চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মহিষের দইয়ের বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি পেয়েছি আমরা। যা মানুষের দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের এই গবেষণায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
দইয়ে ক্ষতিকর অণুজীবের উপস্থিতি কমিয়ে আনার বিষয়ে বলেন, এটা মূলত আসে অসাবধানতার জন্য। দুধ প্রসেস থেকে শুরু করে পরিবহনসহ পুরোটা প্রক্রিয়ায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পরবর্তীতে ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের দই নিয়ে কাজ করার কথা জানান তিনি।
এই গবেষণায় আরও ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মার্শাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজের গবেষক আলফ্রেড চ্যান এবং কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ জাভেদ ফয়সাল। ডেইরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুনায়েদ সিদ্দিকি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. নাজমুল হক। এছাড়াও গবেষক দলে ছিলেন বাংলাদেশ ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের মোহাম্মদ জাকির হোসেন, বিসিএসআইআর চট্টগ্রামের গোলাম মোস্তফা ও আবু বক্কর সিদ্দিক। গবেষণাগারে পুরো কাজটি সম্পাদন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা ইয়াসমিন তানজিনা ও মেহেদী হাসান রুমি।
রুমান/আরএআর