১৮০ বছরের গৌরবময় পথচলায় ঢাকা কলেজ
‘নিজেকে জানো’ মূলমন্ত্রে পথচলা দেশের প্রথম বিদ্যাপিঠ ঢাকা কলেজ। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত কলেজটি ১৮০ বছরের পথচলায় সাক্ষী হয়েছে বাঙালির অনেক ইতিহাসের।
১৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণিল আলোয় সেজেছে রাজধানীর ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস। শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকেই ১৮১তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আলোকসজ্জা করা হয় পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে।
ঢাকা কলেজ প্রশাসন কলেজের ১৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯ ও ২০ নভেম্বর কলেজ প্রাঙ্গণ এবং কলেজ প্রাচীরে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হবে। একইসাথে ২০ নভেম্বর সকাল নয়টায় শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীর সমন্বয়ে আনন্দ র্যালি, দুপুর তিনটায় ঢাকা কলেজের খেলার মাঠে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, রাত আটটায় অনুমতি প্রাপ্তি সাপেক্ষে আতশবাজি ফুটানো হবে। ঢাকা কলেজের বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রদর্শনী স্টল এবং আলোচনাসভার তারিখ ও সময় পরবর্তীতে জানানো হবে।
শত-সহস্র চড়াই-উৎরাইয়ের মাঝেও সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার জাল বুনেছে ঢাকা কলেজের শত শত বিদ্যার্থী। জাতির অনেক মেধাবী সন্তান ধন্য হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়ে। শুধু দেশেই নয় বরং উপমহাদেশের বিদ্যারণ্যে প্রবীণ এক বৃক্ষের নাম ‘ঢাকা কলেজ’।
প্রায় ১৫ যুগ ধরে ঢাকা কলেজ গড়ে তুলেছে দেশের সেরা সন্তানদের। সেসব সাফল্যের হাত ধরে সময়ের সাথে সুনামের সুউচ্চ চূড়ায় গৌরবের সঙ্গে মহিয়ান এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের অসংখ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও এই উপমহাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ পথচলায় মেধাবী তরুণদের স্বপ্নের ক্যাম্পাসের নাম ঢাকা কলেজ। তারা এখানে স্বপ্ন নিয়ে আসেন মেধার বিচ্ছুরণ ঘটাতে যে আলোক বর্তিকায় আজও আলোকিত ঢাকা কলেজ।
বর্তমানে মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়নরত। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২০টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। সেগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, প্রাণীবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পরিসংখ্যান, হিসাববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, দর্শন, আইসিটি।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধায় রয়েছে আটটি ছাত্রাবাস। সেগুলো হলো- উত্তর ছাত্রাবাস, দক্ষিণ ছাত্রাবাস, পশ্চিম ছাত্রাবাস, আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস, শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাস, দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস ও শহীদ শেখ কামাল ছাত্রাবাস।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কবে, ইতিহাস কী বলে
দীর্ঘদিন ধরে ১৮ জুলাইকে ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে জমকালো আয়োজনে পালন করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গত কয়েক বছর ১৮ জুলাইয়ের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে ২০ নভেম্বর।
ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আয়েশা বেগম ২০২০ সালে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে বিভ্রান্তি দীর্ঘদিনের। জুলাই মাসের যে তারিখটি ধরা হয় ওই তারিখে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেখান থেকে পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি ২০ নভেম্বর। তবে আমি অধ্যক্ষ থাকাকালীন নির্দিষ্ট তারিখ ধরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করিনি। সাবেক, বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিলনমেলার আয়োজন করেছি কয়েকবার।
যেহেতু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটি নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে সেহেতু একটি কমিশন গঠন করে বিষয়টি গেজেট আকারে প্রকাশ করে বিভ্রান্তি দূর করা যেতে পারে— এমনটি মনে করেন সাবেক এই অধ্যক্ষ।
এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নেহাল আহমেদ ২০২০ সালে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ঢাকা কলেজ একটি প্রাচীন কলেজ হওয়ায় এর প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। এমনকি কোনো গেজেটও নেই। এর আগে ভিন্ন ভিন্ন দুটি দিনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছিলেন সাবেক দুই অধ্যক্ষ।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিভ্রান্তি এড়াতে ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন মোল্লা একটি কমটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটি এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
তবে ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত ঢাকার তৎকালীন জয়েন্ট কালেক্টর আর্থার লয়েড ক্লের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই ‘ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল’ নামে বাংলার প্রথম সরকারি ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয় ঢাকাতে। পরবর্তীতে ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলেজ শাখার উদ্বোধন করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা কলেজ’। ‘প্রিন্সিপ্যাল হেডস অব দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস অব দ্য ঢাকা ডিভিশন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রতিষ্ঠাকালীন পুরো সময়কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ক্লের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ ‘ঢাকা কলেজ’ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশপসহ স্থানীয় কমিটির সদস্যরা বিদ্যালয় পরিদর্শনের পর অনুষ্ঠানস্থলের দিকে অগ্রসর হন। এখানেই বিশপের উপযোগী এক বক্তৃতা শেষে মি. প্র্যাট (তৎকালীন প্রধান শিক্ষক) তাম্রফলকে মুদ্রিত লিপি পাঠ করেন, যা ভিত্তিপ্রস্তরে স্থাপন করার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
ক্লে লিখেছেন, অতঃপর মি. প্র্যাট একটি লেখ্যপট পাঠ করেন যাতে লেখা ছিল— ‘ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানে বাংলার এই অংশের যুবকদের শিক্ষার জন্য ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই ভারত সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি, যা ঢাকা কলেজ নামকরণ নিয়ে একটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে ৮০৯ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং যাদের আটটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে আটজন শিক্ষক দ্বারা ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়।’
আর্থার লয়েড ক্লের প্রতিবেদনের এই তথ্যকে ভিত্তি করেই ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। তবে এই তারিখটিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘোষণা করে কোনো গেজেট হয়নি। কলেজ কর্তৃপক্ষও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি।
আরএইচটি/এইচকে