রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হাসান আজিজুল হক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে তাকে গ্রন্থাগারের সামনে দাফন করা হয়।
গতকাল সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির বাসভবন উজানে তার মৃত্যু হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসান আজিজুল হকের মরদেহ তার কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানানো শেষে দুপুর ১২টায় মরদেহ নেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়। প্রথমেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী চলে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন।
এ সময় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, রাজশাহী-৩ (পবা ও মোহনপুর) আসনের সাংসদ আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শ্রদ্ধা জানাতে আসা শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন, হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তার চেতনা ও মূল্যবোধ জাতির বিবেককে বহুকাল ধরে জাগ্রত রাখবে।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সরকার সুজিত কুমার বলেন, তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের জন্য একজন হীরকখণ্ড ছিলেন। আমি মনে করি, তিনি নোবেলের দাবিদার। মরণোত্তরও তাকে নোবেল দেওয়া যেতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশে প্রগতিশীল চিন্তার যে আন্দোলন তার অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন তিনি। তিনি অনবদ্য, অতুল্য। তার চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
শহীদ মিনারে শুভাকাঙ্ক্ষীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে কিংবদন্তীতুল্য এই কথাসাহিত্যিককে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে দাফন করা হয়।
জানাজার শুরুতে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘আগুন পাখি’ আজ আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিলেন। এ শোক সইবার নয়। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
জানা গেছে, ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হাসান আজিজুল হক। তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই তিনি অধ্যাপনা করেন।
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি কৈশোরেই। কাশীশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বিদ্যালয়ে রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষ্যে সম্বর্ধনাপত্র রচনা করেন তিনি। প্রবেশিকা পাশের পরপরই তিনি লেখেন উপন্যাস ‘মাটি ও মানুষ’। সেটি অপ্রকাশিতই থেকে যায়।
তবে লেখক হিসেবে তিনি সবার দৃষ্টি কাড়েন ১৯৬০ সালের দিকে। ওই সময় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় তার ‘শকুন’ গল্প প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৯৫৬ সালে নাসির উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘মুকুল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প ‘মাটি ও পাহাড়’। এছাড়া বিএল কলেজবার্ষিকীতে ছোটোগল্প ‘লাঠি’ এবং কবিতা ‘সাগর পারের পাখিরা’ প্রকাশ পায়।
এ সময় ‘পাষাণ বেদী’ নামে একটি গল্পও প্রকাশ পেয়েছিল অন্য একটি কলেজবার্ষিকীতে। সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে হাসান আজিজুল হক কবিতা রচনায়ও আগ্রহী হয়েছিলেন। ‘বিনতা রায় : আমি’, ‘নিরর্থক’, ‘গ্রামে এলাম’, ‘দিনাবসান’, ‘কথা থাক’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি কবিতা তিনি ১৯৫৭ সালে রচনা করেছিলেন।
তিনি ১৯৫৭ সালে ‘শামুক’ উপন্যাস রচনা করে মানিক স্মৃতি উপন্যাস প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ওই সময় ‘শামুক’ উপন্যাসের আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৬০ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ ত্রৈমাসিক পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ গল্প প্রকাশ পায়। এটিই তাকে ব্যাতিক্রমী কথাশিল্পীর পরিচয় এনে দেয়। এরপর থেকেই দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকে।
তার লেখা উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে, বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭) প্রভৃতি।
তার লেখা ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। এই উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। এ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ ২০১৩ সালে এবং তৃতীয় উপন্যাস ‘শামুক’ ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। ‘শিউলি’ নামে আরও একটি ছোট উপন্যাস তিনি লিখেছেন। এছাড়া কবিতা, নাটক, শিশু সাহিত্যসহ স্মৃতিকথাও রচনা করেছেন তিনি।
হাসান আজিজুল হক ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০১২ সালে তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি পান। ২০১৯ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।
এছাড়া বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ (১৯৮৮) বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন হাসান আজিজুল হক।
মেশকাত মিশু/আরএআর/জেএস