কেন সাড়ে ৩ বছরেও হয়নি ঢাবি ছাত্রলীগের হল কমিটি?
দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হল কমিটি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর এক বছরের জন্য ১৮টি হলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক বছর পরই এর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে নেতাদের দিকনির্দেশনায় কাজ করেও কমিটি না পেয়ে হতাশ প্রার্থীরা। তাদের কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে পড়াশোনায় মগ্ন হয়েছেন, কেউবা চাকরিতে প্রবেশ করেছেন আবার অনেকে সেরেছেন বিয়ে।
২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সনজিত চন্দ্র দাসকে সভাপতি এবং সাদ্দাম হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি ঘোষণা করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কমিটির মেয়াদ এক বছর। গত ৩১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। মেয়াদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে কমিটি দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রায় তিন বছরেও ঢাবি শাখা কমিটি তা পারেনি। যদিও দ্রুত হল কমিটি দেওয়া হবে বলে বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঢাবি ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
ঢাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সনজিত-সাদ্দাম কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে কমিটি অতিরিক্ত আট মাস সময় পেয়েছে। কমিটি দেওয়ার সদিচ্ছা থাকলে এর মধ্যেই তারা দিতে পারতেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিটি গঠন করলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা কেটে যেত।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। হল ছাত্রলীগের পদপ্রার্থীরা কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগের শীর্ষ চার নেতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শীর্ষ চার নেতাই হলগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ ভাগাভাগি করে নেন। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে আটকে আছে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাবির হল কমিটি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের পদপ্রত্যাশী মো. আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হলগুলো ছাত্রলীগের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। সাড়ে তিন বছর ধরে হল কমিটি নেই। এ অবস্থায় থাকলে ভবিষ্যতে হল রাজনীতি নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে, নেতাকর্মীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
তিনি বলেন, আমরা অনেক সংগঠন দেখেছি, যারা হল বন্ধ থাকার পরও কমিটি দিয়েছে। আমাদের নেতাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, তারা চাইলেই দিতে পারেন। ভার্চুয়াল সম্মেলন করেও কমিটি দেওয়া যায়, যেমনটি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হল কমিটির পদপ্রত্যাশী এক নেতা বলেন, ক্যাম্পাস রাজনীতিতে একটা নির্দিষ্ট বয়সের ব্যাপার থাকে। একটি ব্যাচের পর আরেকটি ব্যাচ আসে। নেতৃত্বের পরিবর্তন হয় নিয়মিত। কিন্তু ঢাবির হলে সাড়ে তিন বছর ধরে নতুন কোনো নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। এটি ছাত্রলীগের জন্য অশনি সংকেত।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও হল সংসদের সাবেক ভিপি কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা ছাত্রলীগের হল কমিটির প্রার্থী রয়েছেন, তারা দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর ধরে শ্রম দিচ্ছেন। অনেকে টাকা খরচ করে ঢাকায় অবস্থান করছেন। সংগঠনকে ভালোবাসেন বলেই তারা এভাবে ধৈর্য ধরে আছেন। এ অবস্থায় দায়িত্বরতরা যদি করোনা এবং নেত্রীর সঙ্গে কথা না বলেও নেত্রীর রেফারেন্স দিয়ে এড়িয়ে যান, সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগের হল রাজনীতি নষ্ট হয়ে যাবে।
দ্রুত হল কমিটি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটি সংগঠন এভাবে চলতে পারে না। এ বিষয়ে তারা নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সঙ্গে কথা বলুক কিংবা আমাদের কথা বলার সুযোগ করে দিক। করোনাকাল কিংবা যাই হোক না কেন, এর আগেও কঠিন অবস্থা ছিল। সে সময়ে শুধু হল কমিটি নয়, সবগুলো কমিটিই সাংগঠনিক সময় অনুযায়ী হয়েছিল। তারা (ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) দায়িত্ব নিয়ে দ্রুত হল কমিটি দিয়ে দিক। তাদের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সম্মেলনের মাধ্যমে তারা নতুনদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিক।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সোহান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাংগঠনিকভাবে কোনো সংগঠন করোনার জন্য পিছিয়ে নেই। যুবলীগ তার কাজ করছে, আওয়ামী লীগও তার কাজ করছে। ছাত্রলীগের উচিত একটি সিদ্ধান্তে আসা। বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি- সম্পাদক কতটুকু সমন্বয় করছেন, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। এ কারণেই সম্ভবত হল কমিটি হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় এ নেতা বলেন, হল কমিটি দেওয়া সময়ের সেরা দাবি। এ সময়ের মধ্যে না দিলে আর সুযোগ নেই। যারা হলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী, তারা ক্লান্ত হয়ে গেছেন। কমিটি গঠন যদি এভাবে যদি ঝুলে থাকে, তবে পদপ্রার্থীদের রাজনৈতিক, শিক্ষাগত এবং সামাজিক অবস্থান হুমকির মুখে পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নেতার যদি আগ্রহ থাকে, সমন্বয় হয় তাহলে যেকোনো সময়, যেকোনো মুহূর্তে কমিটি দেওয়া সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হল কমিটি ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জন্য বড় একটি প্রত্যাশার জায়গা। এখান থেকে সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ স্বাভাবিকভাবেই সবার জন্য হতাশার। আমরা প্রত্যাশা করছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে, শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক হলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া সুচারুভাবে সম্পন্ন করার মতো সময় শুরু হলে আমরা কমিটি দিতে সক্ষম হব।
বিকল্প কোনো উপায়ে কমিটি দেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে সাদ্দাম বলেন, ক্যাম্পাসের রাজনীতি, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নতুন রক্তের সঞ্চালন, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক গতিময়তা সব কিছুই ঢাবি হল কমিটির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ, সেহেতু বিকল্প উপায়ে (অনলাইনে হোক কিংবা পার্টি অফিসে সীমিত পরিসরে) সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্ব তুলে দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়টি আমরা দায়িত্বরত নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছি, তাদের কাছে অনুমতি চেয়েছি। চেষ্টা করছি, দেখা যাক কী হয়।
কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমন্বয়হীনতার কোনো প্রশ্নই আসে না। সাংগঠনিকভাবে আমাদের প্রস্তুতিও রয়েছে। যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই কমিটি দিতে দেরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ অবস্থায় কোনো হল, বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কমিটি হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি দিয়ে দেব।
এইচআর/আরএইচ