সম্মানজনক পদত্যাগ করেছিলেন ঢাবির যেসব উপাচার্য
১৯২১ সালে যাত্রা শুরু করা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শতবর্ষ পেরিয়ে পদার্পণ করেছে ১০১তম বর্ষে।
বাঙালির জাতিসত্তার বিকাশ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা দুই-ই আছে। নন্দিত উপাচার্য যেমন ছিলেন, তেমনি নিন্দিতও ছিলেন। কেউ বিদায় নিয়েছেন সম্মানের সঙ্গে, কেউ-বা অসম্মান নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন উপাচার্য সম্মানজনক পদত্যাগ করেছিলেন। তারা হলেন-
অধ্যাপক মাহমুদ হুসেইন:
অধ্যাপক মাহমুদ হুসেইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম উপাচার্য। ঢাবির ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬০ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাবির উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে প্রাদেশিক গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ঢাকা কলেজে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপর মোনায়েম খান ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু উপাচার্য মাহমুদ হুসেইন বলেন, ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ঘটেনি, তাই বিষয়টি তার এখতিয়ারবহির্ভূত। এতে মোনায়েম খান অসন্তুষ্ট হওয়ায় ১৯৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ থাকার পরও মাহমুদ হুসেইন পদত্যাগ করেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী:
একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদান করতে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে খবর পান ১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ সংবাদ পাওয়ামাত্র এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগপত্রে স্পষ্ট ভাষায় লিখেন- 'আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’
এভাবে মর্যাদার আসন ছেড়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার নজির ইতিহাসে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। পদত্যাগ করায় ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত উপাচার্যবিহীন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী:
সামরিক সরকারগুলো এমন শিক্ষকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, যারা তাদের প্রতি অনুগত। কিন্তু সামরিক দুঃশাসনের কালেও শিক্ষকসুলভ নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন উপাচার্যের সন্ধান মিলেছে। শিক্ষার্থীদের ওপর সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের নিপীড়নের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। জানা যায়, এরশাদ সরকারের চাপে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ১৯৮৩ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। দায়িত্ব গ্ৰহণ করেছিলেন ১৯৭৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো ছিলেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য এবং নয়াদিল্লী ইউনেস্কোর সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক এম. শামসুল হক:
অধ্যাপক এম. শামসুল হক ১৯৮৩ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মেয়াদকালের শেষ সময়ে এসে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের অন্যায় আদেশ মানতে না পেরে ১৯৮৬ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। সম্পূর্ণ আশির দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল ছিল। জানা যায়, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কারণে মোট ৩৪৮ দিন বন্ধ ছিল।
অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ:
সম্মাজনক বিদায় নেন অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদও। ১৯৯২ সালে ভিসি’র দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৯৬ সালে পদত্যাগ করেন। জানা যায়, প্রভোস্ট নিয়োগ নিয়ে তখনকার শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে একুশে পদক পান এমাজ উদ্দীন আহমদ। শত নাগরিক কমিটির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।
এইচআর/এসএম