‘পতিত সরকারের দোসর’ বলে ববি শিক্ষককে সিন্ডিকেট থেকে অব্যাহতি

জুলাই আন্দোলনকে সমর্থন জানানো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিনকে ‘পতিত সরকারের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। একই সঙ্গে উপাচার্যকে নিয়ে কথা বলে চাকরির বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন মর্মেও অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত রোববার (১৩ এপ্রিল) রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম অব্যাহতি বিষয়ে নোটিশ দেন।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র অধ্যাপক হওয়ায় অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদে মনোনীত হয়ে থাকেন। তিনি এই দুটি পদ থেকে অব্যাহতির আবেদন করলেও ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর বর্তমান উপাচার্য মুহাম্মদ মুহসিন উদ্দিনকে সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদে পুনর্বহাল করেন। ২০২৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত হতে বলেন। মুহাম্মদ মুহসিন উদ্দিন সরাসরি বা অনলাইনে সিন্ডিকেট সভায় যোগদান না করে হোয়াটসঅ্যাপে সভা বয়কটের ঘোষণা দেন। ওইদিন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মুহসিন উদ্দিন উপস্থিত থাকা অবস্থায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গেট, বাসভবন ভাঙচুর করে, যা শোভনীয় ছিল না। ১৭ ফেব্রুয়ারি মুহসিন উদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সংবাদ সম্মেলন করে উপাচার্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন, যা চাকরি বিধিমালা পরিপন্থি।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্যকে ফ্যাসিবাদের দোসর উল্লেখ করা হলেও পুলিশ ভেরিফিকেশনে মুহসিন উদ্দিনের পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক উল্লেখ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠায় নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন তিনি। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় মুহসিন উদ্দিন পতিত সরকারের দোসর। এসব কারণ এবং অব্যাহতিপত্র পর্যালোচনা করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
তবে অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে অপসারণে আইনি বিধান উপাচার্য অনুসরণ করেননি। কারণ আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে আমি পদত্যাগপত্র জমা দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুসারে পদত্যাগপত্র জমা দিলে তা গৃহীত হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এরপর বর্তমান উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র অধ্যাপক হিসেবে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য করার কথা বলেন। আমি সম্মতি দিলে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ১৭(ঞ) ধারা মতে একাডেমিক কাউন্সিল আমাকে দুই বছরের জন্য সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে মনোনয়ন করে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য থেকে অপসারণের ক্ষমতা উপাচার্যের নেই। সুতরাং তিনি নিয়ম ভেঙে অবৈধভাবে আমাকে অপসারণের নোটিশ দিয়েছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পরে তার বেশ কিছু বিতর্কিত কাজের বিরোধিতা আমি করেছিলাম। এজন্য আমাকে হেয় করতে ক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমাকে অব্যাহতির নোটিশ দিয়েছেন।
ড. মুহসিন উদ্দিন বলেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৩৫ জন শিক্ষক ছাত্রদের সাথে একাত্ম হয়ে ছাত্রদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলাম। বিবৃতি দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিল আমার নাম। ওই বিবৃতি দেওয়ার জন্য ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের নানামুখি হয়রানির শিকার হয়েছি।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বললাম আমি, বিবৃতি দিলাম আমি, সেই আমাকে আজ ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যা দিলেন অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। যিনি ফ্যাসিস্টের পক্ষে বিবৃতি দেওয়া ৩৫০ জন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর একজন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম জানান, উপাচার্যের নির্দেশক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এখতিয়ার না থাকলেও সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন কিনা- জানতে চাইলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বলেন, আমিতো একা অব্যাহতি দেইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এভাবে অব্যাহতি দেওয়ার নজির আছে। আমরা বিষয়টি পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় অবহিত করব।
উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমালার ১৭ (ঞ) ধারা লঙ্ঘন করেছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বারবার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে বিবৃতি দেওয়া ৩৫০ জন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীর মধ্যে আমি একজন এমন কোন কথা তিনি (ড. মুহসিন উদ্দিন) বললে তার বিরুদ্ধে মামলা দেব। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে লেখাপড়ার পরিবেশ ফেরানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছি। অথচ যে কয়জন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা করছেন তার মধ্যে সে (ড. মুহসিন উদ্দিন) একজন।
উল্লেখ্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন নিয়ম বহির্ভূতভাবে কয়েকটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। এর মধ্যে পিএ টু রেজিস্ট্রার, পিএ টু ভিসি এবং বর্তমানে দায়িত্ব পালনকারী রেজিস্ট্রার নিয়োগ অন্যতম। এছাড়াও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। আওয়ামী লীগের অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রধান বিতর্কিত বেরোবির সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে স্থান দিয়েছিলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলন করে এসব বিষয় যে সকল শিক্ষক জনসম্মুখে এনেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দিন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর