সাবেক উপাচার্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত বর্তমান প্রশাসন
ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েছে বর্তমান প্রশাসন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
অভিযোগ উঠেছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ না দিয়েই ইতিহাস বিভাগ চালু করেছেন। একই সঙ্গে চলতি বছরের এপ্রিলে ওই বিভাগে ৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। এরই মধ্যে বিগত ৫ আগস্ট সরকার পতন হলে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারিতে জড়িত উপাচার্য সৌমিত্র শেখর আত্মগোপনে থেকে পদত্যাগ করে ছেড়ে যান এই বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঢেলে সাজানো হলে নতুন উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম এবং ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান। দায়িত্ব গ্রহণ করেই ইতিহাস বিভাগের ক্লাস শুরু এবং সাবেক উপাচার্যের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বর্তমান প্রশাসন। বর্তমানে এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগ ও অন্য কলেজের শিক্ষক দিয়ে বর্তমানে ইতিহাস বিভাগে পাঠদান চলছে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান।
তিনি আরও জানান, আগের উপাচার্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ না দিয়ে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। এতে আমরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের লক্ষ্যে কাজ চলছে। সেই সঙ্গে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সাময়িকভাবে ক্লাস শুরু করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত এই সমস্যার সামাধান হয়ে যাবে।
জানা যায়, বর্তমানে দর্শন বিভাগের একটি কক্ষে ক্লাস করছেন ইতিহাস বিভাগের ৩০ জন শিক্ষার্থী। এতে সামযিকভাবে পাঠদান করাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. হাবিবুল উল মাওলা, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ সহকারী অধ্যাপক এ কে এম মাসুদুল মান্নান এবং বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রমজান আলী আকন্দ।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলেন, আলাদা বিভাগ ও শিক্ষক না থাকায় আমরা অন্য বিভাগে ক্লাস করছি। এক্ষেত্রে রুম খালি থাকলে ক্লাস করতে হয় এবং শিক্ষকদের নিজস্ব বিভাগে ক্লাস থাকলে সমস্যা হয়। ইতোমধ্যে আমাদের নজরুল স্টাডিজ, ইংলিশ স্কিল, ইন্ট্রোডাকশন অব হিস্ট্রি ও হিস্ট্রি অব বেঙ্গল এই চারটি কোর্স চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের পাশাপাশি বাইরের একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন। তবে উপাচার্য জানিয়েছেন- আমরা যেন সেশনজটে না পড়ি, সে কারণে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাবের কারণে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। তবে দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখরসহ তার সহযোগীদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বর্তমান প্রশাসন।
গত ২৯ অক্টোবর এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান জানান, বিগত ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর গত ১৭ অক্টোবর ড. সৌমিত্র শেখরের বাসভবন সিলগালা করা হয়। এরপর ২৯ অক্টোবর উপাচার্যের বাসভবন প্রক্টরিয়াল বডি পরিদর্শন করে তার শয়ন কক্ষের আলমারি থেকে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অব্যবহৃত ওএমআর শিট, বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষার খাতা, গুরুত্বপূর্ণ নানা নথিসহ নিয়োগের চিঠি, চাকরি প্রত্যাশীদের বায়োডাটা ও সংসদ সদস্যদের তদবিরের ফাইল উদ্ধার করে। তদন্ত কমিটি জব্দকৃত নথিপত্র অনুসন্ধান করে আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে। সেই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও বিগত সময়ে ভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নির্যাতনসহ নানা অপকর্মের ঘটনায় ১৩ সদস্য বিশিষ্ট সত্যান্বেষণ কমিটি ইতোমধ্যে কাজ করছে। আগামী ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে এই কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, উপাচার্যের বাসভবন থেকে পাওয়া নথিপত্রের তালিকায় রয়েছে ওএমআর শিট দুই খাম, জীবনবৃত্তান্ত, ভর্তি পরীক্ষার ফাইল, নিয়োগ খাতা তিনটি, মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক নিয়োগ খাতা, তদন্ত প্রতিবেদন, ড্রাইভার নিয়োগ, জিএসটি প্রবেশপত্র, প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ, ফোকলোর ও সমাজকর্ম নিয়োগ খাতা, মার্কেটিং বিভাগের অফিস সহায়ক নিয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগ খাতা, বাস হেলপার নিয়োগ খাতা, প্রকল্প বিল ভাউচার, ট্রেজারার নিয়োগ ফাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র।
অপর একটি সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর যোগদান করেন সৌমিত্র শেখর। তার সময়ে ভর্তি পরীক্ষা, নিয়োগসহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেই সঙ্গে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বাইরে তার এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বাড়তি কিংবা সম্পদের তথ্যের জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেও চিঠি দিয়েছে দুদক।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদের দোসররা ক্যাম্পাসের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দখল করে লাগামহীন লুটপাট করেছে মর্মে অসংখ্য অভিযোগ আমরা জেনেছি। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করছে। প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খুব অল্প সময় হয়েছে দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নিয়ে আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। তবে বিগত সময়ের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আমাদের প্রশাসন বিব্রত। তবুও প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে বিগত সময়ের সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। আশা করছি এখন থেকে সকল কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে।
সাবেক উপাচার্যের বাসভবন থেকে নথিপত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরীক্ষা শেষে ওএমআরগুলো সেন্ট্রাল পরীক্ষা কমিটির কাছে দেওয়ার কথা। এগুলো উপাচার্যের বাসভবনে থাকার সুযোগ নেই। এ বিষয়েও উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে, প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আমান উল্লাহ আকন্দ/আরএআর