বন্যা পুনর্বাসনেও অগ্রণী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ছোট্ট গ্রাম বাকশীমূল। বর্ষার বন্যায় ভেসে যাওয়া বাড়িঘর, ক্ষতিগ্রস্ত খামার এবং ভাঙা স্বপ্ন নিয়ে এখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলছে সেখানে। তাদের সেই নতুন শুরুর গল্পে আশার আলো হয়ে এসেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পিএইচডি শিক্ষার্থীদের একটি দল।
ঠিক একই সময় লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার কৃষকেরাও ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় বিভোর। তাদের এই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে শামিল হয়েছে অ্যাগ্রি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ। বীজধানের প্রত্যাশায় সারা দিন অপেক্ষা করাও যেন হার মেনে যায় শেষ বেলার হাসিতে।
বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন পুনর্গঠনের এই মহাযজ্ঞে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছে কৃষকের মাঠে, হাতে তুলে দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার— ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল, মুরগি, উন্নত ঘাসের বীজ, সার, কীটনাশক আর পশুচিকিৎসার সেবা। শুধু ত্রাণ নয়, তারা তৈরি করেছে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেন কৃষকরা এই ক্ষতি কাটিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। তাইতো তারা একেকটি টিম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের একেকটি জেলায়। ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবতা।
বীজধানে নতুন স্বপ্ন বুনন
‘আজ গ্রামে আসছেন বাকৃবির শিক্ষার্থীরা।’ ঠিক এই কথাটা শোনার পর মুহূর্তেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে যায়। কুমিল্লা থেকে নোয়াখালী, ফেনী থেকে লক্ষ্মীপুর, যেখানেই গেছেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা, সকাল থেকেই শুরু হয়েছে অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য। উদ্দেশ্য কৃষকদের মাঝে বীজ ধান বিতরণ করে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করা।
কয়েক ধাপে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০০, কুমিল্লার দেবিদ্বারে ৫০ এবং ফেনীর সোনাগাজীতে ৫০, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ৪০, রায়পুরে ৪০ এবং রামগঞ্জে ২০ জন কৃষকের প্রত্যেককে ২০ শতাংশ জমির জন্য ধানের চারা, সার ও কীটনাশক দেওয়া হয় অ্যাগ্রি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। আর বুড়িচংয়ের বাকশীমূল গ্রামে বাকৃবির পিএইচডি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাম্পেইনে ২০০ খামারিকে উন্নত অস্ট্রেলিয়ান সুইট জাম্বু হাইব্রিড ঘাসের বীজ এবং পাকচুং ঘাসের কাটিং সরবরাহ করা হয়। তাদের প্রতিশ্রুতি— এই ঘাস একবার রোপণ করলে তা ৪ থেকে ৫ বছর উৎপাদন দেবে। এমনকি ৩ বিঘা জমিতে একটি প্যাকেটের বীজ দিয়েই চারা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন
গবাদি পশুর জন্য স্বাস্থ্যসেবা
কুমিল্লায় পিএইচডি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পেইনে ২০০টি গরুকে লাম্পি স্কিন রোগের টিকা দেওয়া হয়। অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গরু ও ছাগলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ঔষধ সরবরাহ, এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেওয়া হয়। বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের অন্য আরেকটি ক্যাম্প পরিচালিত হয় শেরপুরে। এসময় ৩০০ জন খামারির পশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ করা হয়। ক্যাম্পে প্রায় ১০০টি গরুকে তড়কা ও বাদলা রোগের ভ্যাকসিন এবং ৫০টি ছাগলকে পিপিআর ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়। তাদের এই উদ্যোগ যেন আশ্রয়হীন খামারিদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।
ছাগল ও মুরগি, নতুন জীবনের হাতিয়ার
শেরপুরে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য ৭২ জন অসহায় নারীকে বিনামূল্যে অধিক ডিম ও মাংস উৎপাদনশীল ফাওমি ও রড আইল্যান্ড রেড জাতের মুরগি দেওয়া হয়। প্রতি জনকে ৪টি করে মুরগি এবং ১টি করে মোরগসহ মোট ৩৬০টি মোরগ-মুরগি বিতরণ করা হয়। এদিকে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির আরেকটি বিশেষ দিক ছিল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি দরিদ্র পরিবারের মাঝে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিতরণ। এর মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আবার নতুন করে নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে পারবে। এসময় গিয়াস উদ্দিন নামে এক কৃষক এই ছাগল পেয়ে আবেগে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ছাগল পাইয়া আমি অনেক খুশি। স্যারদের আল্লাহ ভালো করুক। উনারা আমাদের জন্য একটা সিঁড়ি তৈরি করে দিয়ে গেলেন, যাতে এই ছাগল পালার মাধ্যমে আমরা ওই সিঁড়ি বাইয়া উঠবার পারি।’
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সচেতনতা
বিশেষায়িত এসব ক্যাম্পেইনের বিশেষজ্ঞগণ শুধু সেবা দিয়েই থেমে থাকেননি। তারা কৃষকদের শিখিয়েছেন মাছ চাষ, পশুপালন, এবং উন্নত ঘাস চাষের কৌশল। প্রতিটি কৃষক হাতে পেয়েছেন প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক লিফলেট, যা ভবিষ্যতে তাদের খামারের উন্নয়নে সহায়তা করবে। প্রতিটি টিম যখন যেখানেই গিয়েছেন তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্থানীয় উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি সার্জনসহ অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞগণ পাশে থেকে সমর্থন ও পরামর্শ প্রদান করে প্রতিটি খামারির মনে সাহস জোগান।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও লক্ষ্য
বাকৃবির পিএইচডি, স্নাতকোত্তর ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচি শেষ করে ফিরে গেলেও তাদের মূল কাজ এখানেই শেষ হয়নি। তারা খামারিদের তালিকা সংরক্ষণ করেছেন, যাতে ভবিষ্যতে আরও পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা যায়। এটি শুধু একটি অস্থায়ী সাহায্য নয়; এটি এক দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের স্বপ্ন, যেখানে কৃষকরা নিজেরাই নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারবেন।
এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
এই কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা যে শুধু ত্রাণ পেয়েছেন, তা নয়; তারা পেয়েছেন নতুন করে বেঁচে থাকার সাহস, একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছেন, ত্রাণ শুধু সাময়িক নয়— সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে তা হয়ে উঠতে পারে স্বপ্ন বুননের সিঁড়ি।
মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর/পিএইচ