হামার মাটির ঘরই ভালো, গরমত ঠান্ডা আর ঠান্ডাত গরম লাগে
গ্রীষ্মের তাপদাহে মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, সব জায়গায় মানুষ যখন গরমে নাকাল, তখন একটু শীতলতার আশায় মানুষের কতো না আয়োজন। ঠিক সেই সময় খানিকটা আরামেই দিন কাটাচ্ছেন মাটির ঘরে বসবাস করা গ্রামের মানুষগুলো। রংপুরের বদরগঞ্জের রোস্তমাবাদ গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা মেলে। এ গ্রামে এখনও রয়েছে সারি সারি মাটির ঘর। এ ঘরগুলো মাটি দিয়ে তৈরি। এলাকাবাসি জানান আগে এ গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই মাটির ঘর ছিল। এখন আধুনিক যুগে মাটির ঘরগুলো কমে যাচ্ছে। এখনও এ গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে মাটির ঘর আছে।
রোস্তমাবাদ গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তি আব্দুল ওয়াহাব। তার বয়স ১১১ বছর। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে চলাচল করেন। তিনি বলেন হামার মাটির ঘরই ভালো। এগলা ঘরত গরমে ঠান্ডা নাগে আর আর ঠান্ডাত গরম নাগে। মানুষ দালান বাড়িতও গরমত থাকপের পায় না, আর হামরা মাটির ঘরত আরামে আছি।
তিনি জানান, তার বাড়িতে ২টা মাটির ঘর রয়েছে। এগুলো ৯০ এর দশকে তৈরি করা হয়েছিলো। তিনি আর তার স্ত্রী একটি ঘরে থাকেন। আর অন্যটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন। এ ঘরগুলো অনেক আগে তৈরি করা হলেও সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে হয়নি। শুধুমাত্র কয়েকবার ঘরের ছাউনি পরিবর্তন করেছেন। আগে ছিলে খড়ের ছাউনি আর এখন ব্যবহার করছেন টিনের ছাউনি।
আব্দুল ওয়াহাবের স্ত্রী জানান, মাটির ঘরগুলো ভালো। তবে কিছুদিন পরপর মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া লাগে। না হলে শ্যাওলা জমে। মাটি ও পানি দিয়ে লেপে দিলে আবারও নতুনের মতো হয়ে যায়।
এ গ্রামের আরেক মাটির বাড়ির সামনে পুত্রবধূকে নিয়ে বসেছিলেন জাহানারা বেগম। তিনি জানান ,তাদের এ মাটির ঘরটি প্রায় ৪০ বছর আগে তৈরি করা। এখন ছেলেরা চাকরি করেন। অনেকের দেখাদেখি তারাও মাটির ঘর চাচ্ছে না। কিছুদিন পর ঘরগুলো ভেঙে হাফ বিল্ডিংয়ের বাড়ি তৈরি করবেন।
ওই এলাকার তারাদুল মিয়া নামের এক কৃষক জানান, তার বাড়িতে একটি মাটির ঘর আছে। এটি তার পূর্ব পুরুষের স্মৃতিচিহ্ন। তার দাদা বেঁচে থাকতে এ বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল।
এলাকার ২ কি.মি. এলাকা ঘুরে প্রায় ২০টি মাটির ঘর দেখা যায়। এলাকাবাসী জানায়, এ এলাকায় আরও অনেক মাটির ঘর আছে। এ এলাকার মাটি ঘর বানানোর উপযোগী। ঘর বানাতে মাটি থেকে দীর্ঘ্য সময় ধরে মণ্ড তৈরি করতে হয়। এ মণ্ড দিয়ে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়। এরপর সেগুলো দিয়ে কয়েকদিনে দেয়াল তৈরি করতে হয় ও সমান করতে হয়। মাটি শক্ত হওয়ার পর উপরে খড় বা টিনের ছাউনি দিলেই মাটির ঘরে বসবাসের উপযোগী হয়। প্রতিটি ঘর তৈরিতে দেড়-দুই মাসের মতো সময় লাগে। তবে মুষলধারে বৃষ্টিতে মাটির ঘরের স্বাভাবিক কাঠামো নষ্ট হওয়ায় লোকজন এই ঘর তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
মাটির ঘর ঠান্ডা থাকার বিষয়ে বেরোবির ইতিহাস ও প্রত্নত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক সোহাগ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাটির ঘরের দেয়ালগুলো অনেক পুরু হওয়ায় সূর্যের তাপ এগুলো ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। আর শীতের সময়েও বাইরের ঠান্ডাও ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। তাই সাধারণত মাটির ঘর গরমকালে ঠান্ডা ও শীতের সময় গরম অনুভূত হয়।
তিনি আরও বলেন, মাটি পোড়ায়ে ইট বানালে ঘনত্ব কমে যায়। তাই কাঁচা মাটির দেয়ালের চেয়ে ইটের দেয়ালে দ্রুত তাপ প্রবেশ ও বের হতে পারে তাই ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি করলেও সেখানে গরমকালে গরম ও ঠান্ডার সময় বেশ ঠান্ডা অনুভূত হয়। যা মাটির দেয়ালে হয় না।
গ্রামীন সংস্কৃতির জীবন্ত জাদুঘর মাটির ঘর গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সাক্ষী। যুগ যুগ ধরে গ্রাম গুলোতে টিকে ছিল এ মাটির ঘর। এ ঘর থেকেই বেড়ে ওঠেছিলো গ্রামবাংলার মহান ব্যক্তিরা। এখনও রংপুর ছাড়াও উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও বগুড়ার কিছু জায়গায় মাটির ঘর দেখা যায়। যুগের বিবর্তনে কমে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে এ গ্রামীন প্রাচীন ঐতিহ্য।
শিপন তালুকদার/এমএএস