ছাত্ররাজনীতি বিহীন ক্যাম্পাসের দাবিতে অনড় বুয়েট শিক্ষার্থীরা
ছাত্ররাজনীতি বিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে নিজেদের অনড় সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। এসময় বুয়েট ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত, অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলে সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরত যাবে বলেও ঘোষণা দেন।
রোববার (৩১ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৫টায় বুয়েট প্রশাসনিক ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা এ কথা জানান।
লিখিত বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা বলেন, দফায় দফায় প্রতিবাদ জানানোর পরও ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টরা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসের ইচ্ছাকে সম্মান না করে বুয়েট ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার নানারকম উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রমাগত অসন্তোষ এখন তীব্র আন্দোলনে রূপ নিয়েছে শুধু একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস চাওয়ার দাবি থেকেই। তাই আমরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি ভুল প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য। আমরা শপথ করছি সব রাজনৈতিক ও নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে বুয়েটকে মুক্ত রাখার। আমরা আবরার ফাহাদ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।
ছাত্ররাজনীতি শুরু হলে সবাই ক্ষমতার শিকলে আবদ্ধ হবে উল্লেখ করে তারা বলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা, কমিটি দেওয়া, ক্যাম্পাসে শোডাউন, রাজনৈতিক সংগঠনের জনসমাবেশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে রাজনীতি মুক্ত রাখার বিধি লঙ্ঘন। এ ছাড়া রাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ যেখানে বুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ, সেখানে রাত ৩টায় একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাংগঠনিক নেতাদের দলেবলে প্রোগ্রাম করা অবশ্যই একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয় এবং সাংগঠনিক রাজনীতির প্রভাবে ঘটা ঘটনা। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বরাবরই একটি নিরাপদ এবং রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস চেয়ে এসেছে, যেখানে ক্ষমতা চর্চার লোভ-লালসার শিকলে আবারো জিম্মি হয়ে যাবে না সবার নিরাপত্তা, শিক্ষাঙ্গনের উপযুক্ত পরিবেশ।
আরও পড়ুন
শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদ হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে বুয়েটের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে বুয়েটের স্বাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়াকে সম্মান করছে না এবং ২০২২ সালে ঢাবি ছাত্রলীগ নেতা বুয়েটে সমাবেশ/মিছিল করে হামলার হুমকি দেয়।
ছাত্ররাজনীতি না থাকায় ক্যাম্পাসের সব আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, সুস্থ নেতৃত্ব এবং নৈতিকতা বিকাশের সব উপাদান ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি ব্যতীতও গত কয়েক বছরে উপস্থিত ছিল এবং এতে নেতৃত্বের চর্চায় শিক্ষার্থীরা তাদের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের বাৎসরিক ফেস্টিভ্যাল আয়োজন, প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং একাডেমিক অর্গানাইজেশন, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, বিভিন্ন ক্লাবের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে আনন্দের সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। আবাসিক হল এবং ক্যাম্পাসে কোনো প্রকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ক্ষমতা চর্চা ব্যতীত বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সভা-সেমিনার আয়োজন, জাতীয় সহশিক্ষা কার্যক্রম, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ অর্জনসহ ক্যাম্পাসের ভেতরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সফলভাবেই সম্পূর্ণ সফলতার সঙ্গে আয়োজিত হয়েছে।
রাজনীতি চর্চা না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গবেষণায় ঝুঁকছে উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, বর্তমান বুয়েটে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ থাকায় নিজ নিজ প্রকৌশল ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামুখী কাজে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্নাতক পর্যায়ের শেষ বর্ষে থিসিসের কাজ কারিকুলামে থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা গবেষণামূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে। একটি রাজনীতিবিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য দেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। তাই রাজনীতিমুক্ত বুয়েটে গত ৫ বছরে এতসব সফলতার পরও ক্যাম্পাসকে নিয়ে নানা অপবাদ দেওয়া কখনোই যৌক্তিক বলে মনে করে না বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।
ছাত্ররাজনীতি বিমুখ মানেই স্বাধীনতাবিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি– এ কথায় দ্বিমত পোষণ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, বুয়েটের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে দেশবাসীর সামনে এ কথা সৎ সাহসের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলতে চায়, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার চেতনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী। প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার এবং প্রচেষ্টা তার সঙ্গে বুয়েটের সব শিক্ষার্থীই একাত্মতা পোষণ করে এবং নিজেদের সুযোগ্য প্রকৌশলী হিসেবে গড়ে তুলে তার জন্য অবদান রাখতে উদ্যমী। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। আমরা শুধু চাই ক্ষমতার লোভ ও অপচর্চা আবারো এসে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে না ফেলুক। আমরা সব শিক্ষার্থীই গর্বের সঙ্গে আমাদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনার চর্চা আমাদের অন্তরে লালন করি।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দপ্তর সম্পাদকসহ অনেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। ছাত্রলীগ নেতাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বি। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বুয়েটে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নতুন করে রাজনীতি শুরুর পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়া ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা তুলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা আন্দোলন শুরু করেন।
কেএইচ/এসএসএইচ