ঢাবিজুড়ে ‘রিকশার গ্যারেজ’, যত্রতত্র মূত্রত্যাগে নষ্ট পরিবেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে রিকশার লাগাম টানার কেউ নেই। হাজারো রিকশা চলাচল করে ক্যাম্পাসে, তাদের ওপর প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রাত নামলে রিকশাগুলোর অস্থায়ী গ্যারেজে পরিণত হয় ক্যাম্পাস। এছাড়া ক্যাম্পাসের যত্রতত্র মূত্রত্যাগ করে পরিবেশ নষ্ট করছেন এই রিকশাওয়ালারা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
গত কয়েকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে সেখানে রাত-দিন সমান তালে রিকশা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও অনেকগুলো রিকশা এমনভাবে জটলা করে রাখা হয়েছে যেন এটি একটি গ্যারেজ। দুপুরের পর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় রিকশা দাঁড় করিয়ে চালকদের ঘুমিয়ে থাকতে দেখা গেছে। আর রাতে নিজ দায়িত্বে ‘গ্যারেজ’ বানিয়ে একসঙ্গে অবস্থান করে অনেকগুলো রিকশা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পাড়ার রাস্তার পাশে, সূর্যসেন হলের সামনে ও আশপাশে, মুহসীন হলের সামনের রাস্তায় ও মাঠের পাশে, টিএসসি-ঢাকা মেডিকেলের রাস্তার পাশে, মল চত্বরের রাস্তা বরাবর এবং পলাশী থেকে জগন্নাথ হল বরাবর রাস্তার পাশেসহ বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী গ্যারেজ বানিয়ে ফেলেছেন রিকশাওয়ালারা।
ক্যাম্পাসের হাজী মোহাম্মদ মুহসীন হলের মাঠের পাশে, ফুলার রোডের ফুটপাতের একাংশ, টিএসসি থেকে মেডিকেল রোডের পাশের ফুটপাথ, পলাশী থেকে সলিমুল্লাহ হলের সামনের রাস্তা, জগন্নাথ হলের পেছনের রাস্তা, শামছুন নাহার হলের সামনের দিকেসহ বেশ কিছু জায়গায় যত্রতত্র মূত্র ত্যাগ করেন রিকশাচালক ও বহিরাগতরা
দিনের বেলায় ক্যাম্পাসের টিএসসি এলাকায় রিকশার আধিক্য ও যত্রতত্র রিকশা থামিয়ে রাখার কারণে চার লেনের প্রশস্ত রাস্তা এক লেনে পরিণত হয়। বিশেষত বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮/৯টা পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করে। টিএসসিতে সব সময় এমন পরিস্থিতি বিরাজ করলেও প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।
এদিকে, মুহসীন হলের মাঠের পাশে, ফুলার রোডের ফুটপাতের একাংশ, টিএসসি থেকে মেডিকেল রোডের পাশের ফুটপাথ, পলাশী থেকে সলিমুল্লাহ হলের সামনের রাস্তা, জগন্নাথ হলের পেছনের রাস্তা, শামছুন নাহার হলের সামনের দিকেসহ বেশ কিছু জায়গায় যত্রতত্র মূত্র ত্যাগ করেন রিকশাচালক ও বহিরাগতরা। এতে নোংরা হয় ক্যাম্পাসের পরিবেশ, ফুটপাত ধরেও নির্বিঘ্নে হাঁটার অবস্থা থাকে না। ফলে অনেকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় গণ শৌচাগার স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত বছরের ৮ জানুয়ারি প্রক্টর বরাবর গণ শৌচাগার স্থাপনের জন্য লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী। এর আগে, ক্যাম্পাসের কিছু স্থান তারা দড়ি দিয়ে ঘেরাও করে দেন। সেখানে জনসচেতনতামূলক পোস্টারও সাঁটিয়ে দেন তারা। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানগুলোতে পুনরায় মূত্রত্যাগ করা শুরু করেছেন রিকশাচালক ও বহিরাগতরা।
বিষয়গুলো নিয়ে একাধিক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের অধিকাংশই থাকেন কামরাঙ্গীরচর বস্তিতে। ক্যাম্পাসের আশপাশে কোনো থাকার জায়গা না থাকায় ক্যাম্পাসেই রাত কাটান তারা। তাছাড়া, ক্যাম্পাসের হল বা সরকারি ভবনগুলোতে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় জরুরি প্রয়োজন পড়লে রাস্তার পাশেই মূত্রত্যাগ করতে বসে যান তারা।
সাইফুল ইসলাম নামে এক রিকশাচালক বলেন, থাকি কামরাঙ্গীরচরে, একদিন পরপর বাসায় যাই। যেতে আসতে সময় লাগে। তাছাড়া সেদিকের প্যাসেঞ্জারও পাই না। তার চেয়ে ক্যাম্পাসের কোথাও রিকশা দাঁড় করিয়ে ঘুমিয়ে যাই। সকালে উঠে খেয়ে আবার রিকশা চালানো শুরু করি।
আরেক রিকশাচালক রহমতউল্লাহ বলেন, খ্যাপ দিতে দিতে রাত হয়ে যায়, তাই আর বাসায় যাই না। সকালে বাসায় যাই, খেয়ে আবার রিকশা নিয়ে বের হই। বাইরে থাকলে রিকশা চুরি হওয়া বা ছিনতাইকারীর হাতে পড়ে সারাদিনের টাকা হারানোর ভয় থাকে। ক্যাম্পাস নিরাপদ জায়গা, এখানে শুয়ে থাকলেও কোনো সমস্যা হয় না।
ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও মূত্রত্যাগে ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্টের ব্যাপারে ঢাবির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাসান তারিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে নেই। তারা শুধু বসে বসে ফাইলে স্বাক্ষর করে দিন পার করেন। ক্যাম্পাসে কে কী করছে, সেটি দেখার সময় তাদের নেই। ক্যাম্পাসকে রিকশাচালকরা নিজেদের গ্যারেজ মনে করেন। বিকেলে টিএসসিতে হাঁটা যায় না তাদের জন্য। আবার রাতেও দেখি বিভিন্ন জায়গায় রিকশা থামিয়ে তারা শুয়ে আছেন। এটা তো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হওয়ার কথা নয়।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় দেখি অনেক রিকশাচালক মূত্রত্যাগ করছেন। ক্যাম্পাসে কোনো মোবাইল টয়লেটও নেই। প্রশাসন এটির ব্যবস্থা করতে পারেনি বলে রিকশাচালকরা ক্যাম্পাসে যত্রতত্র মূত্রত্যাগ করেন। তাছাড়া, তারা জানেন এখানে মূত্রত্যাগ করলে কেউ কিছু বলবে না, এ বিষয়ে তাদের ভয় নেই।
আরেক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। কিছুদিন আগে এক ভাই তাদের উদ্দেশে কথা বলায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ তারা জানে না ওই ভাইয়ের কথাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীর মনের কথা। যত্রতত্র মূত্রত্যাগ করে পরিবেশ নষ্ট করে যাচ্ছে বহিরাগতরা। সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। তারা কোটি টাকা ব্যয়ে পার্ক নির্মাণ করছে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুন্দর পরিবেশ পাচ্ছে কি না সেটি দেখার সময় নেই। তাদের বললেই বলেন এটা উন্মুক্ত জায়গা; এটা আমার না তার কাজ; এটা সিটি কর্পোরেশনের কাজ ইত্যাদি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান এই প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে সরজমিনে উপস্থিত থেকে অভিযান চালানোর কথা বলেন। পাশাপাশি যত্রতত্র থামিয়ে রাখা রিকশা উচ্ছেদের বিষয়ে আশ্বাস দেন।
ক্যাম্পাসে যত্রতত্র মূত্রত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা এস্টেট অফিসের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ভালো বলতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) ফাতেমা বিনতে মোস্তফা বলেন, আমি ছুটিতে আছি। এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না। ছুটি শেষে ফিরে কথা বলব।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আমিও দেখেছি অনেক রিকশাচালক রিকশায় ঘুমাচ্ছেন। আবার অনেকে মূত্রত্যাগ করছেন। আমি নিজেও অনেককে বলেছি, তারা যেন ক্যাম্পাসে মূত্রত্যাগ না করেন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ টাইটনেস কমে যাওয়ায় এটা হয়ত কিছুটা বেড়েছে। আমরা এটা নিয়ে আগেও কাজ করেছি, এখনো যারা দায়িত্বে আছেন তারাও কাজ করছেন। সার্ভিলেন্স সিকিউরিটির দায়িত্বরতরা এ বিষয়টি দেখবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক সমস্যা দূর করতে প্রশাসন সবসময় সচেতন রয়েছে।
কেএইচ/কেএ