চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ পেয়েও রহস্যজনক নীরবতা ঢাবি প্রশাসনে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে এমফিল ও পিএইচডি থিসিসে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ পেয়েও নিশ্চুপ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এমনকি কমিটি গঠনের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি।
সর্বশেষ গত ২৯ আগস্ট এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে উপাচার্য বরাবর একটি চিঠি দেন বিভাগের স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণকারী সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফ বিল্লাহ। তবে মোহাম্মদ বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নতুন নয়। একই অভিযোগের কথা উল্লেখ করে ২০২০ সালে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে অধ্যাপক বাহাউদ্দীনকে দীর্ঘ ৩ বছর ধরে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না, এমনকি তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি।
সাধারণত কারও বিরুদ্ধে গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে কমিটি তদন্ত করে বিষয়টি সিন্ডিকেট মিটিংয়ে উপস্থাপন করেন এবং সিন্ডিকেট সদস্যরা এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত নেন।
গবেষণায় জালিয়াতির অভিযোগে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুকের পদাবনতি করা হয়। এদের মধ্যে সামিয়া রহমানকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান শিক্ষা ছুটি শেষে চাকরিতে যোগদান করার পর আরও দুই বছর প্রভাষক এবং সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুকের পিএইচডি ডিগ্রি বাতিলসহ তাকে প্রভাষক পদে অবনমন করা হয়।
পরবর্তীতে, ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক আবুল কালাম লুৎফুল কবীরের ২০১৪ সালে করা পিএইচডি ডিগ্রিতে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আনা হলে সিন্ডিকেট কর্তৃক সেই পিএইচডি ডিগ্রি বাতিল করা হয় এবং তাকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদাবনতি দিয়ে সহকারী অধ্যাপক করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আরও অনেক শিক্ষককে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির জন্য বিভিন্ন মেয়াদের বিভিন্ন শাস্তি প্রয়োগ করা হয়েছে।
• দুর্নীতির অভিযোগ করায় ‘অব্যাহতি’, উপেক্ষিত হাইকোর্টের রায়!
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এটা অনেক পুরাতন খবর, এটা নিয়ে একদল দুষ্টু লোক তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা চরিতার্থ করতে চাচ্ছে এবং সাংবাদিকদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। সমাজে কিছু দুষ্টু লোক আছে যারা মানুষের খুঁত ধরে অসম্মানিত করার চেষ্টা করে। এটা সিন্ডিকেট সভায় ওঠার সম্ভাবনা নেই। তার পিএইচডি ও এমফিল থিসিস নিয়ে আমরা একবার একজনকে দেখিয়েছিলাম, তিনি সেখানে তেমন মিল খুঁজে পাননি। এখন কলা অনুষদের ডিন সাহেব বিষয়টি দেখছেন। তিনি দেখে বিস্তারিত রিপোর্ট করবেন। রিপোর্টে পিএইচডি ও এমফিল থিসিসে মিল পাওয়ার কথা উল্লেখ হলে সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।
বাহাউদ্দীনের পিএইচডি ও এমফিল গবেষণার পেপার কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির নিরীক্ষণ করে বিষয়টির সত্যতা পেয়েছেন বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আমার কাছে কারও অভিযোগ আসেনি। আমি কারও লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই এতদিনে সেটার একটা বিহিত করতাম।
কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছিরের নিরীক্ষণের বিষয়ে জানানো হলে মাকসুদ কামাল বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে ডিন মহোদয়ের সাথে কথা বলব। দেখি তিনি কী বলেন, উনার কাছ থেকে এ ব্যাপারে সত্যতা জানতে পারলে অবশ্যই সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, অধ্যাপক বাহাউদ্দীনের পিএইচডি ও এমফিল গবেষণা জালিয়াতির কথা সবারই জানা। এ ব্যাপারে অনেক পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি এতটাই পরিষ্কার যে, একজন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীও তার এমফিল ও পিএইচডির সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাবে। কিন্তু উপাচার্য কী উদ্দেশ্যে তাকে বারবার ছাড় দিয়ে যাচ্ছে আমার জানা নেই।
• কার অধীনে যাচ্ছে সাত কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব?
অপর একজন শিক্ষক বলেন, কত অপরাধ করলে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা যায় আমার জানা নেই। অধ্যাপক বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে এত বেশি অভিযোগ রয়েছে যার হিসেব নেই। এমফিল ও পিএইচডি গবেষণায় জালিয়াতির খবর অনেক পুরোনো। বিষয়টি উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রশাসনের মোটামুটি সবাই কমবেশি জানেন। তিনি পরীক্ষার রেজাল্টে অসংগতির জন্য ৩ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেও তাকে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডেও রাখা হয়েছে।
পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় তার বিরুদ্ধে শাস্তির কথা উত্থাপিত না হলে বা তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা না হলে অধ্যাপক বাহাউদ্দীন শাস্তি থেকে সাময়িক রেহাই পেয়ে যেতে পারেন বলে মনে করেন তিনি ।
এ বিষয়ে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড আবদুল বাছির বলেন, ফারসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফ বিল্লাহ উপাচার্যসহ আমাদেরকে তার চিঠি দিয়েছিলেন অধ্যাপক বাহাউদ্দীনের ব্যাপারে তদন্ত করতে। আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে থিসিসগুলো দেখেছি।
এর বাইরে তিনি কিছু বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
গবেষণায় চৌর্যবৃত্তিতে আইন কী বলে?
পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করা হয়।
২০২২ সালের ১৪ আগস্ট উচ্চ শিক্ষাসহ যেকোনো পিএইচডি গবেষণায় জালিয়াতি রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে হাইকোর্ট।
পরবর্তীতে ঢাবিতেও গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি একটি নীতিমালা প্রবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। চৌর্যবৃত্তি বা প্লেজারিজম প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিকে জরিমানা সাপেক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে সংশোধনে ব্যর্থ হলে সামঞ্জস্যের চার লেভেল অনুযায়ী জরিমানা, পদাবনতি ও ডিগ্রি বাতিল- এমনকি চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়।
বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
অধ্যাপক বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে সর্বপ্রথম ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ‘এমফিলের থিসিসে পিএইচডি’ শিরোনামে এবং ২০ অক্টোবর সংবাদ পত্রিকায় ‘ঢাবি অধ্যাপকের এক গবেষণায় দুই ডিগ্রি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বহুদিন বিষয়টি নিয়ে কোনো আলাপ না হলেও চলতি বছরের অক্টোবরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
চলতি বছরের ২৯ আগস্ট ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্বেচ্ছা অবসরগ্রহনকারী সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফ বিল্লাহ এক লিখিত অভিযোগ উপাচার্য বরাবর প্রদান করে বিষয়টি আবারও সকলের নজরে আনেন। অভিযোগের সঙ্গে তিনি ৩৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন। আরিফ বিল্লাহ যেদিন অভিযোগ জমা দেন তার পরদিন সিন্ডিকেট মিটিং থাকলেও সেখানে উপাচার্য বিষয়টি উত্থাপন করেননি।
ড. আরিফ বিল্লাহ তার লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন— অধ্যাপক ড. বাহাউদ্দীনের এমফিলের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে মরমী সাহিত্য ও রূমী চর্চায় ছৈয়দ আহমদুল হকের অবদান’ এবং পিএইচডির বিষয় ছিল ‘সৈয়দ আহমদুল হক ও বাংলাদেশে সুফিবাদ’। দেখা যায় তার এমফিল ও পিএইচডির বিষয় একই শুধু নামে কিছুটা পার্থক্য রাখা হয়েছে। দুটি শিরোনামে একই গবেষণা প্রকাশ করেন তিনি।
ড. আরিফ বিল্লাহ আরও লিখেছেন— প্রথমে এমফিল থিসিস সম্পন্ন করা হয়েছে এবং এই থিসিস থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি ও অনুচ্ছেদ হুবহু পিএইচডি থিসিসে ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়মসিদ্ধ উদ্ধৃতি বা রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়নি যা অ্যাকাডেমিক বিচারে গুরুতর চৌর্যবৃত্তিমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। অভিযোগ উঠেছে যে অনেকাংশে একই ধরনের লেখা বা তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে দুটি ডিগ্রি অর্জন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
• ঢাবি শিক্ষক রহমত উল্লাহর অব্যাহতির সিদ্ধান্ত হাইকোর্টে বাতিল
অধ্যাপক বাহাউদ্দীনের এমফিল ও পিএইচডি থিসিসে ব্যবহৃত রেফারেন্সবিহীন উদ্ধৃতি, হুবহু সাদৃশ্য ও আনুষঙ্গিক বিষয় সংবলিত ৩৩ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণে দেখা যায় অধ্যাপক বাহাউদ্দীন এমফিল থিসিসের ১৩, ৪৫-৪৬, ৫০, ৬৯, ৭০, ৯২, ৯৩-৯৪, ৯৫, ৯৭, ১১০, ১১৭, ১২০, ১২১, ১২২-২৩, ১২৪, ১২৬-৩৩, ১৩৬ -১৩৭, ১৭২-১৭৫ পৃষ্ঠাগুলোতে রেফারেন্স বিহীন উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন।
এ ছাড়াও পিএইচডি থিসিসে ২২, ৬৭ ৬৮, ১০৭-১১০, ১১৩, ১৬২-১৬৯, ২৩৬, ২৩৯ পৃষ্ঠাগুলোতে রেফারেন্স বিহীন উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন।
পিএইচডি করেছি ২০১১ সালে, দীর্ঘ সময় কেউ অভিযোগ করেনি
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. বাহাউদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার শুরুটা হয়েছিল ২০২০ সালে, যখন আমি চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছিলাম। সেটা ঠেকাতেই এমন অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল। অথচ আমি পিএইচডি করেছি ২০১১ সালে। দীর্ঘ একটা সময় কেউ কোনো অভিযোগ তোলেনি। আমি শুধু একটি থিসিস নিয়েই পড়ে নেই। আমার ২৩টি বই আছে, ৭০-এর বেশি আর্টিকেল রয়েছে এবং নিয়মিত ৪/৫টা পত্রিকায় আমি লেখালেখি করছি। তা ছাড়া আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় যা করেছি অন্য কেউ সেটা করে দেখাতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ থিসিস জার্নালে আমার থিসিসের বিবরণ দেওয়া রয়েছে৷ কোনো সমস্যা থাকলে প্রশাসন সেটা দেখবে। এখন সামনে শিক্ষক নিয়োগ ভাইভার ডেট পড়ায় বিষয়টি আবার সামনে আনা হয়েছে। আমি মনে করি আমার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতেই একটি বিশেষ মহল তৎপরতা চালাচ্ছে যা প্রতিটি বিভাগেই লক্ষ্য করা।
কেএইচ/এনএফ