বারান্দায় থেকেই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করলেন ঢাবি শিক্ষার্থী!
আবাসিক হলে একটি বৈধ সিটের জন্য বারবার আবেদন করেছেন, আন্দোলন করেছেন, লেখালেখি করেছেন তবুও মেলেনি সেই সোনার হরিণ! শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বারান্দায় থেকেই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থীর নাম মাহবুবুর রহমান সাজিদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র। বৈধ সিটের জন্য অন্তত ২০ বার আবেদন করেও সিট না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে সম্প্রতি স্নাতকোত্তরের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হল ছাড়েন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মাহবুবুর রহমান সাজিদ নয়। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এমন বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন। এছাড়া বর্তমানেও স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বারান্দা ও গণরুমেই রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলে ছাত্রত্ব নেই এমন শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ রুম দখল করে রয়েছেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষার্থী এই হলে নিয়মিত অবস্থান করছেন। অঘোষিতভাবে হলের সিট বণ্টনের দায়িত্ব ছাত্রলীগকে দেওয়া, হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।
হলে উঠতে না পারার কারণ জানতে চাইলে সাজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, হলের সিট পেতে বৈধভাবে যা করার দরকার ছিল আমি সবই করেছি। গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং সিট পলিটিক্সের প্রতিবাদে লেখালেখি এবং আন্দোলন করেছি। হল প্রশাসনকে অন্তত ২০টি আবেদন লিখেছি। কিন্তু হল প্রশাসন আমাকে সিট দিতে পারেনি। আমি চাইনি ছাত্রলীগের মাধ্যমে সিটে উঠে অন্যায়ের হাতকে সমর্থন করতে। তাই পুরো সময়টাই আমাকে বারান্দায় কাপড় দিয়ে ঘেরা খুপরিতে কাটাতে হয়েছে।
তিনি বলেন, হলের নিচ তলার রুমগুলোর দায়িত্ব হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের। আর উপর তলার রুমগুলোর দায়িত্ব সভাপতির। বৈধ কর্তৃপক্ষ প্রশাসন পুতুলের ভূমিকায়। হল অফিস রুমগুলো দয়া করে ছাত্রলীগকে ছেড়ে দিয়েছে। এই অবস্থান থেকে তারা একজন শিক্ষার্থীকে কীভাবে রুম দেবে! রুমে বৈধভাবে উঠতে না পারার জন্য দায়ী অমেরুদণ্ডী হল প্রশাসন।
তিনি আরও বলেন, মাস্টার্স সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে হল ছেড়ে দিয়েছি যাতে একটি সুস্থ চর্চা চালু হয়। সকল শিক্ষার্থী যেন এভাবে সিট ছেড়ে দিতে আগ্রহী হয়। যাতে পরবর্তীতে নবীনদের বারান্দা এবং গণরুমে কষ্ট করতে না হয়। যদি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল প্রশাসন সিস্টেমে পরিবর্তন না আনে, ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত না করে তাহলে পরিবর্তন আসবে না। তবে আমরা বিবেকের জায়গা থেকে যথাসাধ্য অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা চালু রাখতে পারি।
‘আলহামদুলিল্লাহ, মাস্টার্স সমাপ্তির সাথে সাথেই আল্লাহ হল ছেড়ে দেওয়ার তাওফিক দিয়েছেন’ লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থী। সেই স্ট্যাটাসে তার বারান্দায় থাকার বিষয়টি উঠে আসে এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
জাহিদুল ইসলাম জাহিদ নামে সাজিদের এক সহপাঠী লিখেন, ‘তোমার জন্য খুবই খারাপ লাগে। এস.এম হল কর্তৃপক্ষ একটা সিটে তোমাকে তোমার অধিকার বুঝিয়ে দিতে পারল না। একটা ছেলে বারান্দায় থেকে মাস্টার্স শেষ করল! আর ব্যাচের সবার আগে হল ছাড়ল। এই অনুভূতিটা বলার মতো নয়। আমি নিজেও মাস্টার্স ১ম সেমিস্টারে রুমে উঠেছিলাম করোনার পর। কারো কাছে ছোট হতে পারিনি বলেই এত দেরি। তোমার জন্য শুভকামনা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ১৩টি আবাসিক হলের সব কটির চিত্র কমবেশি একই। হল পরিচালনার জন্য প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের সমন্বয়ে প্রশাসন রয়েছে। কিন্তু হলের নিয়ন্ত্রক কার্যত ছাত্রলীগ। এই সংগঠনই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হলে কারা থাকবে, কে কোন আসনে থাকবে, তা ঠিক করে দেয়। এ কারণে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভিন্নমতের শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের ৪র্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পড়াশোনার জন্য সেভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার সুযোগ হয়নি। যার ফলে আজও বারান্দায় অবস্থান করছি। সিট বণ্টনের দায়িত্ব হল প্রশাসনের হলেও তারা দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। ঢাবিতে ভর্তি হয়ে বারান্দায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাটিয়ে দিতে হবে কল্পনাও করিনি।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রদলের সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন শাওন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হলে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীরা থাকতে পারে না। অথচ এই হলের সিট পাওয়া সব শিক্ষার্থীর অধিকার। শুধুমাত্র ছাত্রলীগের সঙ্গে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করলেই এখানে সিট পাওয়া সহজ। হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এর জন্য দায়ী। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং সহাবস্থান নিশ্চিতের আহ্বান জানাচ্ছি।
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, হল প্রশাসনের কাজে ছাত্রলীগ কখনো হস্তক্ষেপ করে না বরং সহযোগিতা করে। আমরা হল প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছি যাদের ছাত্রত্ব শেষ তাদের বের করে দেওয়ার জন্য। তাদের স্থলে যেন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়া হয়। এখানে রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য বিষয় নয়।
বিষয়টি দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা ও নিজেরদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করছে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের দাবি হলের সব শিক্ষার্থীকে সিট দেওয়া সম্ভব নয়।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বর্তমান প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল রউফ মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা অবশ্যই কষ্টের বিষয় তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী এই বাস্তবতার শিকার। সবাইকে সিট দেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া ওই শিক্ষার্থী যদি আমার কাছে আবেদন নিয়ে আসতেন আমি বিষয়টি দেখতাম। হয়ত এর আগের প্রভোস্টদের আবেদন দিয়েছিল।
এ বিষয়ে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন শিক্ষার্থী স্নাতক-স্নাতকোত্তর বারান্দায় থেকেই শেষ করবেন এটা কখনোই কাম্য নয়। আমি মনে করি এখানে হল প্রশাসনের দায় ছিল। প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর সবার একসঙ্গে বসে বিষয়টি দেখার দরকার ছিল। আমাদের নানান বাস্তবতা রয়েছে তবুও এটা দুঃখজনক।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একটা করে সিট দিতে পারলে উত্তম হতো। তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সীমাবদ্ধতা আমাদের আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই।
এইচআর/এসকেডি