কেন পারে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারে না। সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনই অভিযোগ তুলেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। করোনা মহামারির কারণে বন্ধ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলা প্রশ্নে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
করোনা মহামারির মধ্যেই গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সেশনজট নিরসনে অনার্স শেষ বর্ষ ও মাস্টার্স পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক শিক্ষার্থী সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটা আর হয়নি। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ১৩ মার্চ পরীক্ষার্থীদের জন্য হল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলা এবং ২৪ মে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হবে- শিক্ষামন্ত্রী এমন ঘোষণা দেওয়ার পর নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ঢাবি প্রশাসন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) জরুরি একাডেমিক সভা ডাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্তই বহাল থাকে।
এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি কাগজে-কলমে স্বায়ত্তশাসিত হলেও প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলাদা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
কামরুল হাসান স্বাধীন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পিএসসি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। পিএসসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার বিপরীতে সাথে সাথে তাদের মতামত এবং সিদ্ধান্ত জানাতে পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক মিটিং ডেকে মন্ত্রণালয়ের সাথে সুর মেলায়। ইউজিসির অধীনে থেকেও যেখানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্লাস পরীক্ষা নিতে পারে, বুটেক্স হল খুলতে পারে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হল খোলা রাখতে পারে, মেডিকেল কলেজের হল ক্যাম্পাস খোলা থাকতে পারে, মাদ্রাসা খোলা থাকতে পারে। সেখানে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কী দেখে এতো ভয় পায়, নিজেরা একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কি রাখে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত হলেও জাতীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। মহামারির সময় জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান
আবু বকর সিদ্দিক নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, হল খোলার তীব্র আন্দোলনের ডাক দিতে হবে। আমরা সদা প্রস্তুত। আন্দোলন ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হয় না। ঢাবি প্রশাসন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অথচ সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করে এই প্রশাসন। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের জন্যই এই প্রতিষ্ঠান।
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে অনেক শিক্ষকেরও। এ বিষয়ে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ম ম আরিফ বিল্লাহ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র অনার্স ফাইনাল এবং মাস্টার্স ফাইনাল ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য হল খুলে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। সেভাবেই আমরা শিক্ষকরা পরীক্ষা নেওয়ার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এমতাবস্থায় কী এমন ঘটে গেল যে আকস্মিকভাবে দেশের সব পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত আরও বিস্মিত করেছে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এবং হল খোলার বিষয়টি তো সীমিত পরিসরে শুধুমাত্র দুটি সেমিস্টারের পরীক্ষা নেওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এই সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে আমি মনে করি।
তবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এটি মানতে নারাজ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত হলেও জাতীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। বিশেষ করে মহামারির সময় জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর না হলে উল্টো ঝুঁকি বাড়বে।
শিক্ষার্থীদের যুক্তি কী
করোনা মহামারির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে একযোগে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। এ ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে নিজ নিজ বাড়ি চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখে সরকার। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই আবার ঢাকামুখী হতে হয়। হল বন্ধ থাকায় ঢাকায় এসে বিভিন্ন এলাকায় মেসে উঠতে হয় তাদের।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রায় এক বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মেসে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। এতে যেমন তাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি মানসিকভাবেও তারা ভেঙে পড়ছেন। আর যেসব শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, তারা ঢাকায় টিকে থাকতে পারছেন না। গ্রামে ইন্টারনেটের ধীর গতি ও পর্যাপ্ত ডিভাইস না থাকার কারণে তাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।অন্যদিকে, ঢাকায় না থাকলেও, একাডেমিক ফি দিতে ও পড়ালেখার নানা উপকরণ সংগ্রহ করতে ঠিকই শিক্ষার্থীদের ঢাকায় আসতে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বারবার ঢাকায় আসা-যাওয়ার কারণে তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
হল খুলে দেওয়ার দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও গত কয়েকদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থীরা জোর করে হলে ঢুকে পড়েন। শিক্ষার্থীরা কিছু হলের রুমে ঢুকে পড়েন, আর একদল শিক্ষার্থী হল মাঠে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন সেদিন।
এএইচআর/এনএফ