ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদের আগ্রহ থাকলেও অনীহা প্রশাসনের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে আজ (১১ মার্চ)। দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলায়তন ভেঙে ২০১৯ সালের এই দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বশেষ নির্বাচন। তখন এটিকে ক্যালেন্ডার ইভেন্ট হিসেবে চালু রাখার কথা বললেও নতুন নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
ডাকসু ও হল সংসদের সর্বশেষ নির্বাচনে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫ পদের ২৩টিতেই জয় পায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। শুধু ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয় পায় ছাত্র অধিকার পরিষদ। ওই বছরের ২৩ মার্চ দায়িত্ব নেন ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ২০২০ সালের ২২ মার্চ নির্ধারিত ৩৬৫ দিনের মেয়াদ পূর্ণ করার পর ২২ জুন গঠনতন্ত্রে থাকা অতিরিক্ত ৯০ দিনও অতিক্রম করে ডাকসুর কমিটি। ২৩ জুন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভেঙে যায় সেই কমিটি।
বিভিন্ন কর্মসূচি, স্মারকলিপি ও পরিবেশ পরিষদের মিটিংয়ের মাধ্যমে সবসময় ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেটেও এ দাবি উত্থাপন করেছেন ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক। বার বার দাবি জানানোর পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায় পরবর্তী ডাকসু নির্বাচন কবে হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ছাত্র নেতারা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের অধিকার। এটিকে তারা ক্যালেন্ডার ইভেন্ট হিসেবে চান। করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন নির্বাচন হলেও ডাকসু নির্বাচনে উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। এখন সবকিছু সচল থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবি তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সবসময় চাই শিক্ষার্থীদের একটি আইনগত প্ল্যাটফর্ম থাকবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে সেটি পরিচালিত হবে। এর জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সবসময় তাগাদা দিয়ে আসছি। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পেছনে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল ছাত্রলীগ। আমরা আবারও প্রত্যাশা করি যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করবেন এবং নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন।
ঢাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু বিগত ডাকসু নির্বাচনের মতো কারচুপির নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতকে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রশাসনকে আমরা সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পরিবেশ পরিষদের মিটিংয়ের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আমরা অতি দ্রুত ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের জন্য সমান অধিকার এবং সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন চাই।
সহ-অবস্থান নিশ্চিত করে ডাকসু নির্বাচনে দাবি জানিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ। তিনি বলেন, আমরা সর্বশেষ পরিবেশ পরিষদের মিটিংয়েও ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। আমরা বলেছি পরিবেশ পরিষদের মিটিং না ডেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দিতে। ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে আমাদের দাবি অব্যাহত রয়েছে। তবে গতবারের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নয়। একটি সুন্দর, সুস্থ এবং সবার সহ-অবস্থান নিশ্চিত করে নির্বাচন চাই আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বর্তমান যে সংকট তার একমাত্র সমাধান হতে পারে ডাকসু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসাইন বলেন, আমরা দীর্ঘদিন প্রশাসনের কাছে এ দাবি জানিয়ে আসছি। আগামী দিনে আরও বড় কর্মসূচি নিয়ে হাজির হবো। ডাকসু আমাদের অধিকার। এই অধিকার দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।
সহ-অবস্থান নিশ্চিত করে নির্বাচনের দাবি ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকীর। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এর আগেও ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, ডাকসু আদায়ও করেছে। কিন্তু ভোটের নামে হয়েছে জালিয়াতি আর পেশিশক্তির প্রদর্শন। তথাকথিত ডাকসু নেতারা ছাত্রস্বার্থের কথা মোটেও ভাবেনি। বরং প্রশাসনের যোগসাজশে স্বৈরতান্ত্রিক ও দখলদারিত্বের কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করেছে। শুধু নির্বাচন নয়। ভোট যেন ডাকাতি না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের চরম অনীহা, বলছেন সাবেকরা
ডাকসুর সাবেক নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের চরম অনীহা রয়েছে। ২৮ বছর পর যে নির্বাচন হয়েছে সেটিও নানান অজুহাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয়। লিখিত কিংবা মৌখিক কোনো স্টেটমেন্ট দেয়নি প্রশাসন। সর্বশেষ ডাকসুর পঞ্চাশ শতাংশ ফান্ডও এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে বলে দাবি তাদের। ডাকসু থাকলে শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে দরকষাকষির সুযোগ থাকে। সে সুযোগটি বন্ধ রাখতে এবং একক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতেই ডাকসু নির্বাচন দিচ্ছেন না প্রশাসন।
ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সময় শিক্ষক নির্বাচন হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচন হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনগুলো হয়েছে। সেখানে ডাকসু নির্বাচন পেছানো অযৌক্তিক। তারপরও আমরা ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় খুললে প্রশাসন নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তারা তা করেনি। এ বিষয়ে তাদের সদিচ্ছা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে ডাকসু নির্বাচন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব। ২৮ বছর পরও ডাকসু নির্বাচন হওয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার থমকে গেছে।
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে প্রশাসনের চরম অনীহা রয়েছে উল্লেখ করে সর্বশেষ জিএস গোলাম রাব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে অলিখিতভাবে আমাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো আছে নাকি নাই, না থাকলে কবে ভেঙেছে, ভাঙবে কিনা কিংবা কন্টিনিউ হবে কিনা কোনো কিছুই আমাদের মৌখিক কিংবা লিখিতভাবে জানায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অথচ এখন পর্যন্ত আমাদের অনেকগুলো ইস্যু রয়ে গেছে, ফান্ড রয়ে গেছে। এটাই প্রমাণ করে ডাকসু নির্বাচনের প্রতি প্রশাসনের চরম অনীহা।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই ডাকসুর যে অচলায়তন ভেঙে আমরা আসছি এ ধারাটা অব্যাহত থাকুক। নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারলেই ডাকসু পাওয়ার জন্য আমরা যে সংগ্রাম করেছি, তা পূর্ণতা পাবে। করোনা সংকট কাটিয়ে এখন সবকিছু খুলেছে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত। আমি ডাকসুর জিএস হিসেবে নির্বাচন সফল করতে শতভাগ সহযোগিতা করে দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সাবেক হতে চাই।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের ভাবনা
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কোনো ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখনও প্রশাসন এই নির্বাচন নিয়ে ভাবেনি। ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে করোনা ছিল, জনসমাগম বন্ধ ছিল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতির বিষয় আছে, নানাবিধ পরিকল্পনা আছে।
তবে ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও উপাচার্যের অনুপস্থিততে রুটিন দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেন, ডাকসু একটি বড় কর্মযজ্ঞ, এ বিষয়ে উপাচার্য ভালো বলতে পারবেন।
এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির চর্চা শক্তিশালী হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
তিনি বলেছিলেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এই নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতা যেমন প্রত্যাশিত, একইভাবে পুরো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী করা জরুরি। এটি অনেক সময় বড় আকারের ধাক্কা খায়। এগুলো বিবেচনায় নিয়েই ডাকসু নির্বাচনের মতো বড় কর্মপ্রয়াস গ্রহণ করতে হয়।
এইচআর/এমএইচএস