জনপ্রিয় হচ্ছে হেলিকপ্টার সেবা
আগে হেলিকপ্টারকে বলা হতো বিত্তশালীদের বাহন, যেন বিলাসিতার বস্তু। তবে এখন ভোগান্তিবিহীন যাত্রা আর জরুরি প্রয়োজনে হরহামেশা ব্যবহার হচ্ছে হেলিকপ্টার৷ আকাশপথের এ বাহন এখন আর বিলাসের বিষয় নয়, বাস্তব প্রয়োজনে বেড়েছে এর ব্যবহারও। জরুরিভিত্তিতে করপোরেট যাতায়াত, বিদেশি বিনিয়োগকারী-ক্রেতাদের কারখানায় আনা-নেওয়া, ঈদের আগে বাড়ি ফেরা, এমনকি ঘোরাঘুরির (ট্যুরিজম) ক্ষেত্রেও দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে।
এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুমূর্ষু রোগীদের বহন করে ঢাকায় আনা, ইদানিং আবার হেলিকপ্টারে চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার প্রবণতাও বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশে বর্তমানে ১০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হেলিকপ্টার সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বহরে ৩৫টির মতো হেলিকপ্টার রয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজেও এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে
এ সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশ থেকে আসা বায়ারদের (বিদেশি ক্রেতা) কারখানায় আনা-নেওয়া এবং জরুরি চিকিৎসায় বর্তমানে হেলিকপ্টারের চাহিদা বেশ। বাড়িফেরা ও ঘোরাঘুরিতেও বেশ জনপ্রিয় এ বাহন। তবে মহামারি করোনার কারণে এর ব্যবহার আগের চেয়ে কমেছে।
দেশে বর্তমানে ১০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হেলিকপ্টার সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বহরে ৩৫টির মতো হেলিকপ্টার রয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজেও এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে। হেলিকপ্টারের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মেঘনা এভিয়েশন লিমিটেড, স্কয়ার এয়ার লিমিটেড, বিআরবি এয়ার লিমিটেড, ইমপ্রেস এভিয়েশন লিমিটেড, পারটেক্স এভিয়েশন লিমিটেড, বসুন্ধরা এয়ারওয়েজ, বিসিএল এভিয়েশন লিমিটেড, আর অ্যান্ড আর এভিয়েশন লিমিটেড, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স লিমিটেড ও বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স লিমিটেড।
যেসব ক্ষেত্রে বেড়েছে হেলিকপ্টারের ব্যবহার
হেলিকপ্টারের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশের তৈরি পোশাক খাতের বিদেশি ক্রেতারা এটির ব্যবহার বেশি করছেন। এছাড়া দেশে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উপদেষ্টা ও প্রকৌশলীরা এর সেবা নিচ্ছেন।
হেলিকপ্টার অপারেটররা বলছেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর অনেক বিদেশি বাংলাদেশে আসা ও চলাফেরা সীমিত করেন। বিশেষ কোনো মিটিং থাকলে তারা ভারত বা আশপাশের দেশে শেষ করতেন। তবে বর্তমানে তারা বিমানবন্দরে নেমে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে হেলিকপ্টারে চড়ে বসছেন। বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রামের মতো দূরের গন্তব্যে তারা এটি ব্যবহার করছেন। মিটিং শেষে রাতেই ঢাকায় ফিরে আসছেন। যদি কোনো কাজ না থাকে তাহলে তারা ফিরতি ফ্লাইট ধরে নিজ দেশে চলে যাচ্ছেন।
এছাড়া নাটক কিংবা সিনেমার শুটিং, রাজনৈতিক নেতাদের সফরেও হেলিকপ্টারের ব্যবহার হচ্ছে। মালিকরা নিজেদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনেও এটি ব্যবহার করছেন। মেঘনা এভিয়েশন লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আনোয়ারুল হক সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা প্রতিদিন ১০টার মতো ফ্লাইট পরিচালনা করছি। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে এ সংখ্যা আরও বেশি ছিল। বর্তমানে বেশি ব্যবহার হচ্ছে রোগী আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে। এছাড়া মেগা প্রোজেক্ট এলাকা যেমন- পায়রা বন্দর, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঈশ্বরদীর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রভৃতি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে যেতে হেলিকপ্টারের ব্যবহার বেশি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়িক ভিজিট ছাড়াও রাজধানীকেন্দ্রিক ঘোরাঘুরিতে অনেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। আমাদের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি ট্যুরের দুটি প্যাকেজ আছে। কক্সবাজার যেতেও অনেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। শুধু দিন নয়, রাতেও হেলিকপ্টারের ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি আছে আমাদের। প্রায় রাতেই আমরা রাজশাহী, সিলেট, যশোর, কক্সবাজার রুটে যাতায়াত করি।
স্কয়ার এয়ারের তিনটি হেলিকপ্টার বর্তমানে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক, ফ্লাইট অপারেশনস (ডিএফও) ও প্রধান পাইলট সৈয়দ সাখাওয়াত কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, হেলিকপ্টার সার্ভিস এখন জরুরি সেবা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জরুরি মেডিকেল সেবা, ট্যুরিস্টদের ঘোরাঘুরি, করপোরেট ভিজিটের জন্য এর ব্যবহার হচ্ছে বেশ। আমরা স্বাভাবিক সময়ে মাসে ২০ থেকে ৩০টা ফ্লাইট পরিচালনা করতাম। করোনার কারণে এ সংখ্যা কমেছে। আশা করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগের চেয়ে বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারব। কারণ দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে।
হেলিকপ্টার সেবায় করোনার হানা
দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হেলিকপ্টার সার্ভিসে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এভিয়েশন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, করোনার কারণে করপোরেট ভিজিট কমেছে, কমেছে ট্যুরিস্টদের আনাগোনাও। শুধুমাত্র ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিসের চাহিদা বেড়েছে। স্কয়ার এয়ার বলছে, স্বাভাবিক সময়ে তারা মাসে ২০ থেকে ৩০টি রুটে আসা-যাওয়া করত। বর্তমানে এটি কমে ১০-এ এসেছে।
ইমপ্রেস এভিয়েশন লিমিটেডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে একটা হেলিকপ্টার মাসে ৬০ ঘণ্টা ফ্লাই করত। এখন ফ্লাই করে ২০ থেকে ২৫ ঘণ্টা। কমার্শিয়াল ফ্লাইটগুলো আগের চেয়ে কমে গেছে। আগে বিভিন্ন কোম্পানির বিদেশি ক্রেতারা কারখানা ভিজিটে যেতেন। করোনার কারণে এটি কমেছে। এছাড়া ঈদের আগে ফ্লাইটের চাপ থাকত। এখন সেটিও নেই।
তৈরি হবে হেলিপোর্ট
হেলিকপ্টার রাখার জন্য বাংলাদেশে পৃথক কোনো জায়গা বা হেলিপোর্ট নেই৷ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশেই হেলিকপ্টারগুলো রাখা ও ওঠা-নামানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হেলিকপ্টারের জন্য সরকার পৃথক হেলিপোর্ট তৈরির পরিকল্পনা করেছে। রাজধানীর খিলক্ষেতের কাওলায় হবে এ পোর্ট৷
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানায়, খিলক্ষেতে ৩৫ একর জায়গা নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী নকশা তৈরির কাজ চলছে। হেলিপোর্টে একসঙ্গে সর্বনিম্ন ৮০টি হেলিকপ্টার থাকতে পারবে৷ এর নাম দেওয়া হবে বঙ্গবন্ধু হেলিপোর্ট।
এটিকে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের এক্সটেনশন হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিল বেবিচক। তবে থার্ড টার্মিনালের অর্থের জোগানদাতা জাইকা এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে শিগগিরই হেলিপোর্ট তৈরির কাজ হবে বলে জানিয়েছে বেবিচক।
ঘণ্টা হিসাবে একটি হেলিকপ্টার ভাড়া করতে (হেলিকপ্টারের মডেল ও ধারণক্ষমতা ভেদে) ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা লাগে। সঙ্গে দিতে হবে সরকার নির্ধারিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এছাড়া যাত্রা বিরতির ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টার জন্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়
ভাড়া কেমন
ঘণ্টা হিসাবে একটি হেলিকপ্টার ভাড়া করতে (হেলিকপ্টারের মডেল ও ধারণক্ষমতা ভেদে) ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা লাগে। সঙ্গে দিতে হবে সরকার নির্ধারিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এছাড়া যাত্রা বিরতির ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টার জন্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়।
কীভাবে হেলিকপ্টার ভাড়া করবেন
এ খাতের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে হলে যাত্রা ও গন্তব্যের স্থান, যাত্রীদের পরিচয় ইত্যাদি উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে৷ বিদেশি যাত্রীদের ক্ষেত্রে পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিতে হবে।
এছাড়া হেলিকপ্টার যেখানে নামবে সেখানে যাত্রীর নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে তাকে আগেই ওই থানায় যোগাযোগ করতে হবে। বুকিং পাওয়ার পর যাত্রীর তথ্য নিয়ে হেলিকপ্টার কোম্পানিগুলো সিভিল এভিয়েশনের কাছে উড্ডয়নের আবেদন করে৷ সাধারণ যাত্রায় উড্ডয়নের অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে আবেদন করতে হয়৷
এআর/এসএম/এমএআর/