অনিশ্চয়তায় প্রবাসীরা, সংকটে এয়ারলাইন্সগুলো
সাত বছর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেননি দুবাইপ্রবাসী রাহাত আলী। এবার আগেভাগেই ছুটি নিয়ে রেখেছিলেন। দেশে ফিরে মা আর স্ত্রীর সঙ্গে রোজা পালন করবেন। গত ৩ এপ্রিল টিকিট ইস্যু করেন। দেশে ফিরে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য বনানীতে একটি হোটেলও নিশ্চিত করেন। কিন্তু দুদিনের নোটিশে ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্তে দেশে আর ফেরা হলো না রাহাত আলীর।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় রাহাতের। বলেন, টিকিট ও ১৪ দিনের হোটেল খরচ বাবদ এক লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। লকডাউন শেষ হলে টিকিটের তারিখ পরিবর্তন করতে হবে। হোটেলের টাকা আদৌ ফেরত পাব কি না, তা এখনও জানি না। তারা এখনও কিছু জানায়নি। নতুন করে টিকিট হলে আবার নতুন করে হোটেল বুকিং দিতে হবে। সবমিলে অনেক ভেজালে পড়ে গেলাম।
রাহাতের মতো হাজার হাজার প্রবাসী সরকারি কঠোর বিধিনিষেধের (লকডাউন) কারণে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। আবার বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরাও দেশ ছাড়তে পারছেন না। সময় মতো না গেলে ‘চাকরি থাকবে না’— এমন অনেকেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে আটকা পড়েছেন।
রাহাতের মতো হাজার হাজার প্রবাসী সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। আবার বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরাও দেশ ছাড়তে পারছেন না। সময়মতো না গেলে ‘চাকরি থাকবে না’— এমন অনেকেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে আটকা পড়েছেন
তবুও বিমানবন্দরে প্রবাসীদের অপেক্ষা
বগুড়ার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৫০) ও মো. আব্দুল হাকিম (৪০)। ঢাকায় এসেছেন জর্ডান যাওয়ার উদ্দেশে। আসার আগে অবশ্য এয়ার এরাবিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাদের বলেছে, ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
কিন্তু তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে দেখেন, করোনা প্রতিরোধের বিধিনিষেধের জন্য সব অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ। কোনো কিছু জানার জন্য তারা বিমানবন্দরের ভেতরেও প্রবেশ করতে পারছেন না।
গেটের সামনে কর্তব্যরত এপিবিএন সদস্য তাদের থামিয়ে জানিয়ে দেন, ‘বিমানবন্দর বন্ধ। এখন ভেতরে যাওয়া যাবে না।’ ফলে বিপদে পড়েন আনোয়ার হোসেন ও আব্দুল হাকিম। প্রবাসে যেতে পারবেন কি না, না যেতে পারলে টিকিটের অর্থ ফেরত পাবেন কি না— তা নিয়ে সংশয়ে পড়েন তারা।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) বিকেলে ৪টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তারা। জর্ডান থেকে আনোয়ার হোসেন গত মার্চ মাসে এবং আব্দুল হাকিম জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে আসেন। আসার সময় দুজনই ফিরতি টিকিট করে এসেছিলেন। টিকিটের তারিখ অনুযায়ী আনোয়ারের ফ্লাইট আজ (বুধবার, ১৪ এপ্রিল) এবং হাকিমের ফ্লাইট বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল)।
ফ্লাইটের সময় ঠিক থাকবে কি না, তা জানতে গত ৫ এপ্রিল এবং সর্বশেষ ১৩ এপ্রিল এয়ার এরাবিয়া এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। কোম্পানির কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, ঢাকা থেকে আম্মানগামী (জর্ডানের রাজধানী) ১৪ এপ্রিল ও ১৫ এপ্রিলের ফ্লাইট চালু আছে। যথা সময়ে ফ্লাইট ঢাকা থেকে আম্মানের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
কর্তৃপক্ষের এমন আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আনোয়ার হোসেন ও আব্দুল হাকিম গত ১৩ এপ্রিল রাতে রাজধানীতে পৌঁছান। আজ দুপুরে তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এসে দেখেন সবকিছু বন্ধ। তাদের বিমানবন্দরের ভেতরেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা লুৎফুর রহমান লিটন বলেন, ‘দুই মাস আগে সৌদি আরব থেকে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসি। আসার সময় একই ফ্লাইটে ফিরতি টিকিট করেছিলাম। আজ আমার সৌদি আরবে ফেরার কথা। কিন্তু এসে দেখি বিমানবন্দর সম্পূর্ণ বন্ধ। করোনা প্রতিরোধের বিধিনিষেধের কারণে কোনো ফ্লাইট ওঠা-নামা করছে না। এরপর ফ্লাইট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা বলে, ঢাকা থেকে তাদের ফ্লাইট চালু রয়েছে। বন্ধ হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন কী করব বুঝতে পারছি না। ফ্লাইট কর্তৃপক্ষ বলছে, ফ্লাইট ওপেন রয়েছে। কিন্তু বিমানবন্দরে এসে দেখি সবকিছু বন্ধ। সময় মতো সৌদি পৌঁছাতে না পারলে চাকরি থাকবে কি না— তা নিয়ে এখন চিন্তায় আছি।’
ফ্লাইট বন্ধের কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বিমান বাংলাদেশ ও ইউএস-বাংলাসহ আন্তর্জাতিক ১০টি এয়ারলাইন্স। তারা বলছে, ফ্লাইট বন্ধের কারণে শিডিউলও (সময়সূচি) পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। ফলে আজ ও আগামী তারিখগুলোতে যারা টিকিট কিনেছেন তাদের ফ্লাইটের শিডিউল মেলাতে ধকল পোহাতে হবে
এদিকে বিমানবন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সকাল থেকেই বিক্ষিপ্তভাবে প্রবাসীরা আসছেন। বুধবার তাদের ফ্লাইট। কিন্তু সবকিছু বন্ধ দেখে আবার ফিরে যাচ্ছেন।
সংকটে এয়ারলাইন্সগুলোও
ফ্লাইট বন্ধের কারণে সংকটের মুখে পড়েছে বিমান বাংলাদেশ ও ইউএস-বাংলাসহ আন্তর্জাতিক রুট পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্সগুলো। তারা বলছে, ফ্লাইট বন্ধের কারণে শিডিউলও (সময়সূচি) পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। ফলে আজ ও আগামী তারিখগুলোতে যারা টিকিট কিনেছেন তাদের ফ্লাইটের শিডিউল মেলাতে ধকল পোহাতে হচ্ছে।
সম্প্রতি সরকার বিশেষ ফ্লাইটের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার চিন্তাভাবনার কথা জানিয়েছে। তবে এতেও সংকট কাটবে না বলে দাবি করছে এয়ারলাইন্সগুলো।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিদেশি একটি এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে সাতদিনের লকডাউন চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে আজ (বুধবার) হঠাৎ স্পেশাল ফ্লাইট পরিচালনার ঘোষণা দিল। কিন্তু স্পেশাল ফ্লাইটের অনুমতি ও ব্যবস্থাপনায় সাতদিনেরও বেশি সময় লেগে যাবে আমাদের।
২০-২৫ হাজার প্রবাসী টিকিট কেটেও বিদেশে যেতে পারছেন না
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এক সপ্তাহে দুবাই, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরের জন্য ইউএস-বাংলার প্রায় চার হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। এগুলো এখন রি-শিডিউল করতে হচ্ছে।’
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারলাইন্স, সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স, ওমান এয়ার, সালাম এয়ার, এমিরেটস, ইতিহাদ এয়ারলাইন্স, এয়ার এরাবিয়া, এয়ার এরাবিয়া দুবাই, ফ্লাই দুবাইয়ের এক সপ্তাহে প্রায় ২০ হাজার যাত্রীকে আনা-নেওয়ার কথা ছিল। ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্তে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশেষ ফ্লাইটের কথা ভাবছে সরকার
প্রবাসীদের ক্ষোভের মুখে তাদের জন্য শিগগিরই বিশেষ ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরগামী কর্মীদের জন্য বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হবে।
বুধবার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বিস্তারিত ওয়ার্ক প্ল্যান নিশ্চিত করবে। তবে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা নেগেটিভ সনদসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এয়ারপোর্টে আনার দায়িত্ব থাকবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর। প্রবাসীকর্মীরা কেবলমাত্র জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মিশনের ছাড়পত্র নিয়ে এবং দেশে প্রযোজ্য কোয়ারেন্টাইন শর্ত মেনে কোভিড- ১৯ নেগেটিভ সনদ নিয়ে দেশে আসতে পারবেন।’
এর আগে ১৩ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে সাতদিনের জন্য আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধের নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেবিচকের সার্কুলারে বলা হয়, আগামী ১৩ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ২০ এপ্রিল রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠা-নামা বন্ধ থাকবে। তবে ত্রাণসামগ্রী, কার্গো, টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং (প্লেনের তেল নেওয়ার জন্য অবতরণ), বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ফ্লাইট ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি চলাচল করতে পারবে। তবে বিমানবন্দর ব্যবহার করা এসব যাত্রীকে বাধ্যতামূলকভাবে যাত্রা শুরুর ৭২ ঘণ্টা আগে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে প্লেনে চড়তে হবে।
এছাড়া এ সময়ের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত চার্টার্ড ফ্লাইটের সব ফ্লাইটকে সরকার নির্ধারিত হোটেলগুলোতে নিজ খরচে ১৪ দিন বাধ্যতামূলকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
এমএসি/এআর/আরএইচ/এমএআর/