এয়ারলাইন্সের ভাড়া নির্ধারণ : জানা-অজানা অনেক ফ্যাক্টর জড়িত
প্লেনের ভাড়ার সঙ্গে বাস কিংবা ট্রেনের ভাড়ার তুলনা অনেকেই করে ফেলেন? দূরত্ব তো একই। সময় একটু কম আর বেশি এই যা? তাতেই দামের এত পার্থক্য? মেনে নেওয়া যায় না। গত মাসে ঢাকা থেকে সৈয়দপুরে যাওয়ার সময় ভাড়া ছিল ৪৩০০ টাকা আর এখন ৫০০০ টাকা এইটা কি করে সম্ভব? এয়ারলাইন্সগুলো মন চাইলেই ইচ্ছেমতো ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছে। প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন একজন যাত্রী। আসলেই কি তাই? একটি এয়ারলাইন্স নানাবিধ ক্যালকুলেশন করে কোনো একটি রুটের যাত্রী ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে। সেটা হোক অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক রুট।
একটি এয়ারলাইন্সের পরিচালন ব্যয়ের চেয়ে ভাড়া যদি কম নির্ধারিত হয়, নিশ্চিতভাবেই এয়ারলাইন্সকে শেষের মাইলফলকটা সময়ের আগেই দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। সারাবিশ্বের বহু এয়ারলাইন্সের সঙ্গে দেশীয় কিছু এয়ারলাইন্সের উদাহরণ রয়েছে। যারা একসময় বিশ্ব এভিয়েশনে আকাশপথে বিচরণ করে বেড়াত। কিন্তু এখন সেই সব এয়ারলাইন্সগুলো ইতিহাসের পাতায় অবস্থান করছে। এয়ারক্রাফট চয়েস কিংবা রুট চয়েস কিংবা সময় চয়েস কিংবা ভাড়া নির্ধারণে ভুল সিদ্ধান্ত একটি এয়ারলাইন্সকে শেষের পরিণতি দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয় অবধারিত ভাবেই।
বাংলাদেশ এভিয়েশনের ৫০ বছরের ইতিহাস অনেকটা বন্ধুর। জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চলার পথটা খুব একটা মসৃণ বলার সুযোগ নেই। আর বেসরকারি বিমান সংস্থা হিসেবে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কিংবা রিজেন্ট এয়ারওয়েজ এর মতো ৮টি থেকে ৯টি এয়ারলাইন্সও নানাবিধ কারণে বন্ধ হয়ে ইতিহাস হয়ে গেছে। টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই দুটি এয়ারলাইন্স এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
শুরু করেছিলাম বিভিন্ন রুটের যাত্রী ভাড়া নিয়ে। সারাবিশ্বের সব এয়ারলাইন্সের সব রুটের ভাড়া নির্ধারণের সময় সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণির ভাড়াকে কয়েকটি ধাপে নির্ধারণ করে থাকে। একটি প্যাসেঞ্জার এয়ারলাইন্সের আয়ের একটি মাত্র উপায় থাকে তা হচ্ছে যাত্রীদের ভাড়া। আর সেই ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব ধরনের খরচের কথা বিবেচনায় রাখতে হয়। সেই ভাড়া নির্ধারণ থেকে শুরু করে প্রতি মূহূর্তের পুনর্বিন্যাস করার প্রতিটি ধাপের জন্য রয়েছে এয়ারলাইন্সগুলোর একটি ডিপার্টমেন্ট, তা হচ্ছে ইলড্ ম্যানেজমেন্ট কিংবা রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট।
একটি রুটের ভাড়া নির্ধারণে অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ (ল্যান্ডিং, পার্কিং, সিকিউরিটি, রুট নেভিগেশন), বিভিন্ন ধরনের নন-অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ (অফিস স্পেস, বোর্ডিং ব্রিজ, হ্যাঙ্গার সুবিধা) ইত্যাদি ফিগুলো বিবেচনায় রাখতে হয়। বিশ্ববাজারে লাগামহীন জেট ফুয়েলের দামের ওঠা-নামা, ভাড়ার উপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। যেকোনো রুটের পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৪০ শতাংশই জেট ফুয়েলের খরচ।
ভাড়া নির্ধারণের সময় বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের ট্যাক্স, সিকিউরিটি ফি, এম্বারকেশন ফি, এক্সাইজ ডিউটিসহ নানাবিধ চার্জকে প্রাধান্য দিতে হয়। ইন্স্যুরেন্স সারচার্জকেও বিবেচনায় রাখতে হয়। বিশ্ববাজারের সঙ্গে ডলারের বিনিময় হারও ভাড়া নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
খরচের খাতে বিমানের ইজারা বা সম্পূরক ক্ষেত্রে আয়কর ও ভ্যাট যুক্ত থাকায় এয়ারলাইন্সের পরিচালন ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই অনুরূপ আয়কর ও ভ্যাট প্রযোজ্য না থাকায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।
মূল্য সংযোজন কর নীতিমালায় আগাম কর বা অ্যাডভান্স ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা পৃথিবীতে খুবই একটি বিরল নীতিমালা। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো তাদের দেশে আগাম কর দিতে হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে বিমান, ইঞ্জিন কিংবা যন্ত্রাংশ আমদানির সময় কোটি কোটি টাকা আগাম কর দিয়ে থাকে। ফলে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় দেশি এয়ারলাইন্সগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেসব ক্ষেত্রে ইজারাকৃত বিমান, ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ বিদেশি মালিককে ফেরত দেওয়া হয়, তখন প্রদত্ত আগাম কর এয়ারলাইন্সগুলোকে সরকার থেকে ফেরত দেওয়া হয় না। এর ফলে অযৌক্তিক খরচের খাতের কারণেও ভাড়া নির্ধারণের সময় এ ধরনের খরচকেও গুরুত্ব বিবেচনায় রাখতে হয়।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া অথবা বেবিচকের মাধ্যমে বিমানবন্দরে ভিভিআইপি ফ্লাইট, বিমানবাহিনীর মহড়া ও অন্যান্য কারণে সাময়িক বন্ধ রাখা কিংবা বিমানের দুর্ঘটনাজনিত কারণে বিমানবন্দর বা রানওয়ে বন্ধ রাখার কারণে ওয়াচ আওয়ার এক্সটেনশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ওয়াচ আওয়ার বৃদ্ধির জন্য এয়ারলাইন্সগুলো কোনোভাবেই দায়ী নয়, কিন্তু বেবিচক এয়ারলাইন্সগুলোকে ওয়াচ আওয়ারের এক্সটেনশনের জন্য ঘণ্টা প্রতি উচ্চ হারে চার্জ আরোপ করে, সেটাও ভাড়ার উপর বর্তায়।
অভ্যন্তরীণ রুটের অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ এর প্রায় ৮ থেকে ৯ গুণ বেশি চার্জ নির্ধারণ করা আছে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য, যা আন্তর্জাতিক রুটের ভাড়া নির্ধারণে প্রভাব পড়ে। আবার জেট ফুয়েলের মূল্য আন্তর্জাতিক রুটের থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটে প্রায় লিটার প্রতি ১১ থেকে ১২ টাকা বেশি দিতে হয়। যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণে সরাসরি প্রভাব পরে থাকে।
প্রশাসনিক খরচ তো রয়েছেই। যেকোনো ট্রেডের খরচের থেকে এভিয়েশনের পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার, কেবিন ক্রুদের বেতনের উচ্চসীমার সঙ্গে রয়েছে ফ্লাই অ্যালাউন্সসহ নানাবিধ খরচ। সব ধরনের খরচই ভাড়ার উপর প্রভাব পড়ে।
একটি এয়ারলাইন্স ব্যবসায়িকভাবে টিকে থাকলেই যাত্রীদের সেবা দেওয়ার সুযোগ পাবে নতুবা ইতিহাসের অংশীদার হয়ে যাবে। আকাশ পরিবহনে কম ভাড়া নয় ভালো সেবা আর অনটাইমে ফ্লাইট পরিচালনার প্রত্যাশা সবার। প্রত্যাশিত সেবাই পারবে দেশীয় এয়ারলাইন্সকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান তৈরি করতে।
লেখক : মহাব্যবস্থাপক, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স
জেডএস