শাহজালালের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধনের সময় জানালেন প্রতিমন্ত্রী
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল উদ্বোধন করা যাবে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী।
সোমবার (১১ এপ্রিল) বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের একথা বলেন।
প্রকল্পের সময়সীমা অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুনে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগের কাজ শুরুর অনুমতি পেতে দেরি হওয়ায় উদ্বোধনের সময় পেছাতে পারে।
পরিদর্শন শেষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে আমরা হয়তো এতদিন আমাদের বিমানবন্দরে যাত্রীদের বিশ্বমানের সেবা দিতে পারিনি। তবে থার্ড টার্মিনাল একটি যুগান্তকারী স্থাপনা হবে। আমরা এখানে বিশ্বমানের যাত্রী সেবা নিশ্চিত করব। আমাদের বিশ্বাস আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের (২০২৩ সালের) মধ্যে আমরা এই টার্মিনাল উদ্বোধন করতে পারব।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, একটি দেশের অতিথি যেন বাংলাদেশে প্রবেশের পরই এই টার্মিনাল দেখে বাংলাদেশের সৌন্দর্য বুঝতে পারে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টার্মিনাল তৈরির নির্দেশ দেন। করোনাকালীন সময়ে সারাবিশ্বের সব যোগাযোগ যখন বিচ্ছিন্ন ছিল, কোথাও যখন কোন কাজ হয়নি, সেই সময়ও আমরা এই থার্ড টার্মিনালের কাজ একদিনের জন্যেও বন্ধ হতে দেইনি। চেয়ারম্যান (বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ-বেবিচকের চেয়ারম্যান) সার্বক্ষণিক কাজের মনিটরিং করেছেন। এছাড়াও যারা এই নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।
পরিদর্শনের সময় বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, থার্ড টার্মিনালের কাজগুলো একটা শিডিউলে চলছে। তবে আপনারা জানেন এই টার্মিনালের সঙ্গে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটা সংযোগ হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ স্থাপনের কাজটার অনুমতি সময়মত না পাওয়ায় এই কাজটি আমাদের শুরু করতে বিলম্ব হয়ে যায়। সেজন্য কাজটা চলমান থাকবে কিন্তু নির্ধারিত সময়ে টার্মিনালের মেজর ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা সম্পন্ন হয়ে যাবে।
বিমান প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৮ এপ্রিল পর্যন্ত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, বাস্তবে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শেষ হবে।
তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজটি কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে তখন এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে টার্মিনালকে যুক্ত করতে হবে। এটিকে আশকোনা হজ ক্যাম্প পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ সময় বেবিচক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান বলেন, টার্মিনালের কাজটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ হচ্ছে। তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন হলে এই বিমানবন্দরে অনেক উড়োজাহাজ আসবে রানওয়েতে। বিমানবন্দরে রানওয়ে একটি। তাই উড়োজাহাজ রানওয়েতে থাকার স্থায়িত্ব যাতে কম হয়, দ্রুততার সঙ্গে যেন তা পার্ক করতে পারে, এজন্য দুটি অতিরিক্ত হাইস্পিড ট্যাক্সিওয়ের নির্মাণ কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা ছিল জুনের মধ্যে এ কাজ শেষ করার। কিন্তু, এই কাজটি এই মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নতুন রাডার স্থাপনের কাজ শুরু হয়ে গেছে বলেও জানান বেবিচক চেয়ারম্যান।
জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালে (টার্মিনাল-৩) থাকছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি প্লেন রাখার অ্যাপ্রোন (প্লেন পার্ক করার জায়গা) করা হচ্ছে। টার্মিনালের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হবে দুই লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার মিটারের মডার্ন টার্মিনাল ভবন।
নির্মাণাধীন টার্মিনালটিতে বেশ কয়েকটি স্ট্রেইট এসকেলেটর লাগানো হবে। যারা বিমানবন্দরের ভেতরে দীর্ঘপথ হাঁটতে পারবেন না, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোতে বেশি যাত্রী প্রবাহের জায়গাগুলোতে এ এসকেলেটরগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি যাত্রীদের একটি শান্ত এবং মসৃণ যাত্রার অভিজ্ঞতা দেবে। যাত্রীদের অত্যাধুনিক ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট থাকবে টার্মিনালটিতে।
টার্মিনালটির প্রতিটি ওয়াশরুমের সামনে থাকবে একটি করে বেবি কেয়ার লাউঞ্জ। এ লাউঞ্জের ভেতর মায়েদের ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা এবং একটি বড় পরিসরে ফ্যামিলি বাথরুম থাকবে। এছাড়াও বাচ্চাদের স্লিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন প্লে এরিয়া, হেলথ ইন্সপেকশন সুবিধা, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট-এইড রুম, নানা রোগের টেস্টিং সেন্টার ও আইসোলেশন এরিয়া থাকবে।
ঘোরাফেরা ও কেনাকাটার জন্য তৈরি নতুন টার্মিনালের ১৪টি স্পটে থাকবে ডিউটি ফ্রি শপ। টার্মিনালের বাইরে ও ভেতরে থাকবে ফুড কোর্ট, ফুড গ্যালারি, ওয়াই-ফাই এবং মোবাইল চার্জিংয়ের সুবিধা। এছাড়াও নারী ও পুরুষের জন্য রাখা হবে পৃথক নামাজের ব্যবস্থা। যাত্রীদের নিতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য মিটার্স অ্যান্ড গ্রিটার্স প্লাজাও থাকবে টার্মিনাল-৩ এ। এই টার্মিনালের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। তৈরি হবে পৃথক একটি স্টেশনও। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের না হয়েই মেট্রোরেলে করে নিজেদের গন্তব্যে যেতে পারবেন। এছাড়া ঢাকার যেকোনো স্টেশন থেকে মেট্রোরেলের মাধ্যমে সরাসরি বিমানবন্দরে ডিপার্চার বা বহির্গমন এলাকায় যাওয়া যাবে।
অত্যাধুনিক এ টার্মিনাল ভবনে থাকবে ১০টি সেলফ চেক-ইন কিওস্ক (মেশিন), ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেইট থাকবে। এতে করে যাত্রীরা ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি না হয়ে সরাসরি নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সেরে ফেলতে পারবেন। তবে কেউ যদি না চায়, সেক্ষেত্রে ৫৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টারও থাকবে।
যেসব যাত্রী অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকবেন তাদের জন্য ৫টি ই-গেট থাকবে। পাশাপাশি থাকবে ৫৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানির জন্য একটি কার্গো ভিলেজ থাকলেও থার্ড টার্মিনালের উত্তর পাশে আলাদা আমদানি-রপ্তানি কার্গো ভিলেজ ভবন করা হচ্ছে। পৃথক কার্গো ভিলেজগুলো থাকবে বিশ্বের উন্নত দেশের বিমানবন্দরের মতো সর্বাধুনিক সুবিধাসম্বলিত। এটি হবে ৬৩ হাজার স্কয়ার মিটারের। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের বর্তমান ধারণক্ষমতা ২ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন। তৃতীয় টার্মিনাল হলে এই ধারণক্ষমতা গিয়ে ঠেকবে ৪ মিলিয়ন টনে।
২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (থার্ড টার্মিনাল) প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় একনেক। নির্মাণ কাজে অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বৃহৎ এই থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পটির ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে অবশ্য প্রকল্প ব্যয় ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করছে স্যামসাং গ্রুপের কনস্ট্রাকশন ইউনিট স্যামসাং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ট্রেডিং (সিঅ্যান্ডটি) করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটির নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বুর্জ খলিফা, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, তাইপে ১০১, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনাল, দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও আবুধাবির ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক।
এছাড়াও টার্মিনালের ভেতরের ভবনটির নকশা তৈরি করেছেন বিখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিন। তিনি সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৩, চীনের গুয়াঞ্জুর এটিসি টাওয়ার ভবন, ভারতের আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের নকশা তৈরি করেন।
এআর/আইএসএইচ