সাইবার জগতে নারীর প্রতি সহিংসতা, ইমেইলে হয়রানি, সাইবার বুলিং, সাইবার পর্নোগ্রাফি ও মরফিং প্রতিরোধে ৮ দফা সুপারিশ জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

শনিবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে নারী ও কন্যার প্রতি সাইবার সহিংসতা: বাস্তবতা ও করণীয় বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন এসব সুপারিশ তুলে ধরেন।

কাবেরী গায়েন বলেন, নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতার ক্ষেত্রে সুরাহার পথ দু'টি। প্রথমটি আইনি ব্যবস্থায় জোরারোপ। দ্বিতীয়টি সমাজ মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন সাধন। আইনের ক্ষেত্রে বলতে গেলে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত সাইবার অপরাধের সুনির্দিষ্ট  সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল প্রমাণ এবং সাক্ষ্যের যে প্রক্রিয়া সে বিষয়েও সাধারণের জানা নেই। তৃতীয়ত, সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে নারীর অভিযোগ দাখিলের ক্ষেত্রে যে জড়তা সেটা দূর করার জন্য কোন আইনের কোন সেশনে অভিযোগ দাখিল করে কী ধরনের শাস্তি আদায় করা সম্ভব সেটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা এবং জনগণকে জানানো প্রয়োজন।

সুপারিশসমূহ:
১: যেসব আইন এখন অবধি প্রণীত হয়েছে তাদের কার্যকারিতা এবং কোথায় কোথায় সমস্যা এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। জাতীয় উদ্যোগে যেমন এ গবেষণা হতে পারে, তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও গবেষণা পরিচালিত করতে পারে। আমাদের সমস্যা হল পরিস্থিতি জানার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য আমাদের হাতে নেই।

২: দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার নিশ্চিত করতে পারলে ভুক্তভোগীদের আস্থা ফিরে আসবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর যা তাদের জড়তা কাটাতে সাহায্য করবে। বিচারপদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে ধারণা দেবার জন্য গণমাধ্যম এবং লোকমাধ্যমের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। সহজে ব্যবহার করা যায় এমন মোবাইল অ্যাপস তৈরি করতে হবে সহজে অভিযোগ দাখিলের জন্য।

৩: ভুয়া আইডি শনাক্তকরণ এবং সেসব বাতিল করতে পারলে সাইবার অপরাধ অনেকটাই কমতে পারে। টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে। সাইবার অপরাধীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য সাইবার ব্যবহারকারীদের গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে যেখানে কী করা যাবে এবং কী করা যাবে না তার পরিষ্কার নির্দেশনা থাকবে।

৪: ডিজিটাল লিটারেসির কোন বিকল্প নেই। ফলে ডিজিটাল লিটারেসি ট্রেনিং এবং ডিজিটাল সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক এবং কমিউনিটি সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বড় পরিসরে সচেতনতা তৈরির প্রচারণা চালাতে হবে। এ সচেতনতা প্রচারণার মধ্যে থাকবে ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার, কিশোর-তরুণদের এ মিডিয়া ব্যবহারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধান সম্পর্কে ধারণা ইত্যাদি। এ বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৫: অপরাধ সংগঠিত হয় প্রথমে সাংস্কৃতিক মননে। কিশোর ছেলেরা আগে এলাকার মেয়েদের দিকে শিস ছুঁড়ে দিতে দিতে পুরুষ হয়ে ওঠতো। সমাজে এ ব্যবহারের প্রশ্রয় ছিল। এখন সেই শিস দেয়া মন সাইবার পরিসরে নিজেদের নিয়োজিত করছে। এ মনকে কেবল আইনি কাঠামো বা প্রাযুক্তিক শনাক্তকরণের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করা যাবে না। এর জন্য মনোজগতে পরিবর্তন প্রয়োজন। এ কাজটি সবচেয়ে কঠিন। রাজনৈতিক পরিসরে কিশোর- তরুণ অপরাধী গ্যাং প্রতিপালনের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে। তাই ক্যাম্পেইন পরিকল্পনায় রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সামনে নির্বাচন। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে পরিকল্পনা কী, সেই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।

৬: সামাজিক মাধ্যমে নিয়োজিত অপরাধী মনকে শিক্ষিত করার জন্য, নারী এবং কন্যাদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এবং নারীপুরুষ নির্বিশেষে মানবিক মন গড়ে তোলার জন্য গণমাধ্যমে ছোট ছোট নাটিকা, তথ্যচিত্র প্রদর্শন করার ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ, একটি সর্বমাত্রিক শিক্ষা-সচেতনতা কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে দেশের মানুষকে। সেইসব বার্তার উদ্দিষ্ট গ্রাহক যে কেবল তরুণ নারী-পুরুষ হবেন, এমন নয়। মাতাপিতা, অভিভাবক, স্থানীয় কমিউনিটি নেতা সবাইকেই শিক্ষিত করার লক্ষ্য থাকতে হবে।

৭: সুপারিশ শুরু করেছিলাম পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য গবেষণার অপরিহার্যতা নিয়ে। শেষও করতে চাই গবেষণার কথা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীর প্রতি সাইবার অপরাধ কমানোর জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা জেনে, তাদের ভালো প্র্যাকটিসগুলো আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও গবেষণা।

৮: জেন্ডার বিভক্ত বাংলাদেশের সমাজে নারী ও কন্যাদের প্রতি সাইবার অপরাধ কমানো দেশের সার্বিক নারী ও কন্যাদের মানবিক মর্যাদায় উন্নীত করার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এ কাজটি বহুস্তরভিত্তিক এবং এর জন্য রাষ্ট্রের কমিটমেন্ট প্রয়োজন। প্রয়োজন যথাযথ বিনিয়োগ: বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক।

এমএম/পিএইচ