মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেছেন, নারী আজকে অত্যন্ত জাগরিত একটি শক্তি। এই জাগরণকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আগামী দিনের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে তরুণ প্রজন্মকে বায়াস ব্রেকিংয়ের কাজটি করতে হবে। কিছু পরিবর্তন হচ্ছে তবে তার কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিতের জন্য আইন কাঠামো তৈরি করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্ত করতে হবে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।

৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২২ পালন উপলক্ষে বুধবার (৯ মার্চ) অনুষ্ঠিত অনলাইনে ওয়েবিনারে মডারেটরের বক্তব্যে এসেব কথা বলেন তিনি।

‘নারী-পুরুষের সমতা, টেকসই আগামীর মূলকথা’ প্রতিপাদ্যের আলোকে ‘নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করো, সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করো’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সকাল থেকে দুপুর অবধি অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর দাবি যুক্ত করতে নারী রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকতে হবে, শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারীর জীবনে চলমান নানামুখী সহিংসতা দূর করা নারী আন্দোলনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একে মোকাবিলা করে নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

আন্দোলনে নারী সংসদ সদস্যদের সর্বোতভাবে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সাইবার দুনিয়াকে কীভাবে নারী আন্দোলনের কাজে ব্যবহার করা যায় তা আমাদের ভাবতে হবে, যথাযথ পরিকল্পনা নিতে হবে।

মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে উইমেন ফর উইমেনের সভাপতি ড. নিলুফার বানু বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রগতিতে নারীর অবদান সর্বাধিক, বিশেষ করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম সেক্টরে নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য হলেও প্রত্যাশিত নারী-পুরুষ সমতায় পৌঁছাতে তাদের আরো অনেক দূর অগ্রসর হতে হবে।

বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অবস্থার পরিবর্তনে বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন, সরকারি সুবিধা গ্রহণে প্রদানকৃত শর্তগুলো নারীর জন্য সহজ এবং তথ্যপ্রবাহ গণমাধ্যমে প্রচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বনশ্রী মিত্র বলেন, পরিবার ও কর্মক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধে প্রিভেনশন, প্রটেকশন, প্রভিশন, পার্টিসিপেশন ও রিপোর্টিংয়ের আলোকে আলাদা আলাদা করণীয় ঠিক করতে হবে। প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা রিভিউ করা,  সহজভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল ডাটা প্রাপ্তি, এর পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু কাজ হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং পরবর্তী সুপারিশমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক অ্যাড. নিনা গোস্বামী বলেন, ৮০’র দশক থেকে মহিলা পরিষদ বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন সংস্কার ও প্রণয়নে জোর দাবি উত্থাপন করলেও সরকারের তৎপরতা এখনো পর্যন্ত তেমন দেখা যায় না।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য পরিবারে সমাজে নারীর প্রতি তৈরি হওয়া বৈষম্যগুলোর প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির গল্প পরিবর্তন করে আমাদের সমতার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার দিকটি তুলে ধরতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিচ্ছি কিন্তু ঘটনা ঘটে গেলে তা প্রতিরোধে কোনো প্রভিশন নেই। পরিবর্তন নিজ পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। মিডিয়াতে জেন্ডার বৈষম্যমূলক কনটেন্ট প্রচার বন্ধ করতে কর্পোরেট সেক্টর ও মোবাইল কোম্পানিকে যুক্ত করার ওপর জোর দিতে হবে।

আলোচনা শেষে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কর্মজীবী নারীদের মধ্যে হাসিনা আক্তার, আইইডি থেকে সঞ্চিতা তালুকদার, এডাব থেকে সমাপিকা হালদার, গণসাক্ষরতা অভিযান থেকে শামসুন নাহার, নারী ঐক্য পরিষদ থেকে লুৎফুন নেসা খান, পল্লীমা মহিলা পরিষদ থেকে অ্যাড. নীলাঞ্জনা।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বলেন, অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে সামাজিক অবকাঠামো উন্নতি না হওয়ায় প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে না। বাল্যবিবাহ প্রতিনিয়ত হচ্ছে, কাজীকে শাস্তি আওতায় আনা হচ্ছে না। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কিশোরীদের সচেতন করতে কিশোরী ক্লাব গঠনের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে, এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। বহুবিবাহ এখনো নারীরা সহ্য করে যাচ্ছেন, এখনো বিষয়টি তেমন সামনে আসছে না।

নারীদের অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে উল্লেখ করে বলেন, জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়নে মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে নারীদের নিকট তথ্য প্রচারের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সমতা নিশ্চিতে সামগ্রিক সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের মধ্যে নিহিত সুনির্দিষ্ট বৈষম্যগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে আইন প্রণয়নের জন্য ৭১ নম্বর বিধি, ১৪৭ ধারার সাধারণ প্রস্তাবের আলোকে পয়েন্ট অব অর্ডারে ও ককাসের মাধ্যমে সংসদে দাবি উত্থাপন করার কথা বলেন তিনি।

সংসদ সদস্য শবনম জাহান ৮ মার্চের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, দিবসটির মাধ্যমে এই আন্দোলনের ফসলকে আমরা প্রতিবছর উদযাপন করি এবং প্রতিবছরই নতুন নতুন দাবি উঠে আসছে। দাবিগুলো অনেকাংশেই পূরণ হয়েছে, আর যে দাবিগুলো পূরণ হয়নি তা বাস্তবায়নে সরকার ও সামাজিক শক্তিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ওয়েবনিয়ারে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধি, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় পরিষদ সদস্য, সম্পাদকমন্ডলী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক এবং কর্মকর্তাসহ ৬৪ জন উপস্থিত ছিলেন।

জেইউ/ওএফ