বাংলাদেশে আছে সারি সারি ঝাউবন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন; রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি বিশ্বের ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবন। বিস্ময়কর সৌন্দর্যের বাংলাদেশ এমনভাবে সাজানো যে, দেশের যেকোনো প্রান্তে গেলে কোনো না কোনো আকর্ষণীয় স্থান চোখে পড়বেই। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এত সাজানো প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ নেই। 

এরপরও দেশে ঘুরতে অনীহা মধ্যবিত্তের। কিছু টাকা জমিয়ে চলে যাচ্ছেন পাশের দেশ ভারত-নেপালে। কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছেন মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডের মতো কৃত্রিম সৌন্দর্যের দেশগুলোতে। 

দেশের পর্যটকরা বলছেন, বাংলাদেশে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যেগুলো আবিষ্কার করতে দীর্ঘ ৫০ বছর সময় লেগেছে। এছাড়া অনেক পর্যটন স্থানে স্থানীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। যেকেউ চাইলে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করতে পারেন না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত খরচ। বাংলাদেশ থেকে পাশের দেশগুলোতে থাকা ও খাওয়ার খরচ অনেক কম। তাই একই খরচে বিদেশ গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারায় অনেকেই চার-পাঁচ দিনের জন্য দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসছেন। 

তবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে (হোটেল-রেস্টুরেন্ট), বিদেশে পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো করহারে ছাড়, ইউটিলিটি বিলে ছাড়, ভ্যাট মওকুফসহ নানা প্রণোদনা পেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র। সাধারণের চেয়ে এই খাত সংশ্লিষ্টদের ব্যয় আরও বেশি। তাই চাইলেও খরচ কমানো সম্ভব হয় না। 

বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটররা বলছেন, বিশ্বজুড়ে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। থাইল্যান্ড, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে পর্যটন খাত। বাংলাদেশে এই খাতে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও অতিরিক্ত খরচের কারণে বিদেশমুখী হচ্ছেন দেশীয় পর্যটকরা। 

বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটরদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের দেখা মেলে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে। এখানে অফ-সিজনে একটি তিন তারকা মানের হোটেলে থাকার খরচ (ছাড়ের পর) প্রতি রাতের জন্য চার থেকে ছয় হাজার টাকা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিসহ সরকারি ছুটির দিনগুলোতে এই ভাড়া ১০ থেকে ১২ হাজারে গিয়ে ঠেকে। 

অথচ নেপালের কাঠমান্ডুতে একজন পর্যটককে একই মানের হোটেলের জন্য আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা, ভারতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা, ভুটানে তিন হাজার টাকা, থাইল্যান্ডের পাতায়াতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হয়। 

শব্দ আর দূষণের শহর ছেড়ে শান্তি আর নীরবতার জন্য ঢাকার অনেকেই এখন গাজীপুর-সাভারের মতো আশপাশের জেলাগুলোর রিসোর্টে যান। এসব রিসোর্টে থাকার খরচও বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ থেকে বেশি। মোটামুটি মানসম্মত একটি রিসোর্টে থাকতে প্রতি রাতের জন্য খরচ করতে হয় ছয় থেকে আট হাজার টাকা। তারকামানের রিসোর্টগুলোর খরচ ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত দাঁড়ায়। অথচ একই টাকায় দেশের বাইরে তিন থেকে চার রাত রিসোর্টে থাকা যায়। 

রিভার অ্যান্ড গ্রিন ট্যুরসের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন হেলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ থেকে বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ ভারতে ঘুরতে যান। যদি সেই অনুপাতে হিসাব করি, ভারতে ১০০ কোটির বেশি জনগণ থাকলেও আমরা তাদের পর্যটক পাচ্ছি না। কারণ দেশে এমনও অনেক রিসোর্ট আছে যাদের রুম ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। থাকার খরচটা বেশি লাগায় আমরা পর্যটক কম পাই। 

বিডি ট্রাভেলার্স নামের ট্যুর অপারেটর ও গাইডিং গ্রুপের সদস্য আনিসুর রহমান ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, কক্সবাজারে মানসম্মত একটি রেস্টুরেন্টে ভর্তা-সবজি আর সামুদ্রিক মাছ দিয়ে একবেলা খেতে খরচ পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। যা পাশের দেশগুলোর প্রায় কাছাকাছি। দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার এটিও অন্যতম কারণ। এছাড়া পর্যটন শহরগুলোতে গাড়িভাড়া, কেনাকাটার খরচ অনেক বেশি। স্বাচ্ছন্দ্য নেই বললেই চলে। 

কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসা কেমন— জানতে চাইলে হোটেল কক্স বিচ রিসোর্টের ম্যানেজার মোহাম্মদ নওয়াজ বলেন, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পর্যটন ব্যবসা বছরব্যাপী হয় না। প্রধানত দুই ঈদের পর এবং শুক্র ও শনিবারসহ টানা তিন/চার দিনের বন্ধ থাকলেই কেবল পর্যটকরা আসেন। বাকি সময় কেউ আসেন না। তবে পর্যটনকেন্দ্রিক বিশাল জনবলকে বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য ভরা মৌসুমে ভাড়া কিছুটা বেশি নেওয়া হয়। 

কক্সবাজার হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম জানান, করোনাকালে কক্সবাজারের চার শতাধিক হোটেল-মোটেলের সব কটিতে তালা ঝুলেছে। প্রতিদিন তাদের ১৫ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন তারা কিছু বেশি নিতে পারেন। এছাড়া ভ্যাট-ট্যাক্সসহ পরিচালনা ব্যয় বেশি হওয়ায় সেবার মূল্য কমানো যাচ্ছে না। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার দেব বলেন, বাংলাদেশের ট্যুরিজম প্যাকেজগুলো একটু ব্যয়বহুল। তাই পাশের দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশে না এসে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান বা ভারতের মতো দেশে চলে যাচ্ছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে প্যাকেজগুলো তাদের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে হবে। একমাত্র এভাবেই দেশীয় পর্যটক পাওয়া সম্ভব। 

এআর/এমএআর//